কারাগার হইতে বাহির হওয়ার পর হইতে গোরার কাছে সমস্ত দিন এত লোকসমাগম হইতে লাগিল যে তাহাদের স্তবস্তুতি ও আলাপ-আলোচনার নিশ্বাসরোধকর অজস্র বাক্যরাশির মধ্যে বাড়িতে বাস করা তাহার পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল।
গোরা তাই পূর্বের মতো পুনর্বার পল্লীভ্রমণ আরম্ভ করিল।
সকালবেলায় কিছু খাইয়া বাড়ি হইতে বাহির হইত, একেবারে রাত্রে ফিরিয়া আসিত। ট্রেনে করিয়া কলিকাতার কাছাকাছি কোনো-একটা স্টেশনে নামিয়া পল্লীগ্রামের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিত। সেখানে কলু কুমার কৈবর্ত প্রভৃতিদের পাড়ায় সে আতিথ্য লইত। এই গৌরবর্ণ প্রকাণ্ডকায় ব্রাহ্মণটি কেন যে তাহাদের বাড়িতে এমন করিয়া ঘুরিতেছে, তাহাদের সুখদুঃখের খবর লইতেছে, তাহা তাহারা কিছুই বুঝিতে পারিত না; এমন-কি, তাহাদের মনে নানাপ্রকার সন্দেহ জন্মিত। কিন্তু গোরা তাহাদের সমস্ত সংকোচ-সন্দেহ ঠেলিয়া তাহাদের মধ্যে বিচরণ করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে সে অপ্রিয় কথাও শুনিয়াছে, তাহাতেও নিরস্ত হয় নাই।
যতই ইহাদের ভিতরে প্রবেশ করিল ততই একটা কথা কেবলই তাহার মনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। সে দেখিল, এই-সকল পল্লীতে সমাজের বন্ধন শিক্ষিত ভদ্রসমাজের চেয়ে অনেক বেশি। প্রত্যেক ঘরের খাওয়াদাওয়া শোওয়াবসা কাজকর্ম সমস্তই সমাজের নিমেষহীন চোখের উপরে দিনরাত্রি রহিয়াছে। প্রত্যেক লোকেরই লোকাচারের প্রতি অত্যন্ত একটি সহজ বিশ্বাস— সে সম্বন্ধে তাহাদের কোনো তর্কমাত্র নাই। কিন্তু সমাজের বন্ধনে, আচারের নিষ্ঠায়, ইহাদিগকে কর্মক্ষেত্রে কিছুমাত্র বল দিতেছে না। ইহাদের মতো এমন ভীত, অসহায়, আত্মহিতবিচারে অক্ষম জীব জগতে কোথাও আছে কি না সন্দেহ। আচারকে পালন করিয়া চলা ছাড়া আর কোনো মঙ্গলকে ইহারা সম্পূর্ণ মনের সঙ্গে চেনেও না, বুঝাইলেও বুঝে না। দণ্ডের দ্বারা, দলাদলির দ্বারা, নিষেধটাকেই তাহারা সব চেয়ে বড়ো করিয়া বুঝিয়াছে। কী করিতে নাই এই কথাটাই পদে পদে নানা শাসনের দ্বারা তাহাদের প্রকৃতিকে যেন আপাদমস্তক জালে বাঁধিয়াছে। কিন্তু এ জাল ঋণের জাল, এ বাঁধন মহাজনের বাঁধন— রাজার বাঁধন নহে। ইহার মধ্যে এমন কোনো বড়ো ঐক্য নাই যাহা সকলকে বিপদে সম্পদে পাশাপাশি দাঁড় করাইতে পারে। গোরা না দেখিয়া থাকিতে পারিল না যে, এই আচারের অস্ত্রে মানুষ মানুষের রক্ত শোষণ করিয়া তাহাকে নিষ্ঠুরভাবে নিঃস্বত্ব করিতেছে। কতবার সে দেখিয়াছে, সমাজে ক্রিয়াকর্মে কেহ কাহাকেও দয়ামাত্রও করে না। একজনের বাপ দীর্ঘকাল রোগে ভুগিতেছিল, সেই বাপের চিকিৎসা পথ্য প্রভৃতিতে বেচারা সর্বস্বান্ত হইয়াছে, সে সম্বন্ধে কাহারও নিকট হইতে তাহার কোনো সাহায্য নাই— এ দিকে গ্রামের লোকে ধরিয়া পড়িল তাহার পিতাকে অজ্ঞাতপাতকজনিত চিররুগ্ণতার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। সে হতভাগ্যের দারিদ্র্য অসামর্থ্য কাহারও অগোচর ছিল না, কিন্তু ক্ষমা নাই। সকলপ্রকার ক্রিয়াকর্মেই এইরূপ। যেমন ডাকাতির অপেক্ষা পুলিশ-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা-বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্রাদ্ধ সন্তানের পক্ষে গুরুতর দুর্ভাগ্যের কারণ হইয়া উঠে। অল্প আয় অল্প শক্তির দোহাই কেহই মানিবে না, যেমন করিয়া হউক সামাজিকতার হৃদয়হীন দাবি ষোলো-আনা পূরণ করিতে হইবে। বিবাহ উপলক্ষে কন্যার পিতার বোঝা যাহাতে দুঃসহ হইয়া উঠে এইজন্য বরের পক্ষে সর্বপ্রকার কৌশল অবলম্বন করা হয়, হতভাগ্যের প্রতি লেশমাত্র করুণা নাই। গোরা দেখিল এই সমাজ মানুষকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করে না, বিপদের সময় ভরসা দেয় না, কেবল শাসনের দ্বারা নতি স্বীকার করাইয়া বিপন্ন করে।
শিক্ষিতসমাজের মধ্যে গোরা এ কথা ভুলিয়াছিল। কারণ, সে সমাজে সাধারণের মঙ্গলের জন্য এক হইয়া দাঁড়াইবার শক্তি বাহির হইতে কাজ করিতেছে। এই সমাজে একত্রে মিলিবার নানাপ্রকার উদ্যোগ দেখা দিতেছে। এই-সকল মিলিত চেষ্টা পাছে পরের অনুকরণরূপে আমাদিগকে নিষ্ফলতার দিকে লইয়া যায় সেখানে ইহাই কেবল ভাবিবার বিষয়।