হরিমোহিনী তাঁহার দেবর কৈলাসের নিকট হইতে পত্র পাইয়াছেন। তিনি লিখিতেছেন, ‘শ্রীচরণাশীর্বাদে অত্রস্থ মঙ্গল, আপনকার কুশলসমাচারে আমাদের চিন্তা দূর করিবেন।’
বলা বাহুল্য হরিমোহিনী তাহাদের বাড়ি পরিত্যাগ করার পর হইতেই এই চিন্তা তাহারা বহন করিয়া আসিতেছে, তথাপি কুশলসমাচারের অভাব দূর করিবার জন্য তাহারা কোনোপ্রকার চেষ্টা করে নাই। খুদি পটল ভজহরি প্রভৃতি সকলের সংবাদ নিঃশেষ করিয়া উপসংহারে কৈলাস লিখিতেছে—
‘আপনি যে পাত্রীটির কথা লিখিয়াছেন তাহার সমস্ত খবর ভালো করিয়া জানাইবেন। আপনি বলিয়াছেন, তাহার বয়স বারো-তেরো হইবে, কিন্তু বাড়ন্ত মেয়ে, দেখিতে কিছু ডাগর দেখায়, তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হইবে না। তাহার যে সম্পত্তির কথা লিখিয়াছেন তাহাতে তাহার জীবনস্বত্ব অথবা চিরস্বত্ব তাহা ভালো করিয়া খোঁজ করিয়া লিখিলে অগ্রজমহাশয়দিগকে জানাইয়া তাঁহাদের মত লইব। বোধ করি, তাঁহাদের অমত না হইতে পারে। পাত্রীটির হিন্দুধর্মে নিষ্ঠা আছে শুনিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম, কিন্তু এতদিন সে ব্রাহ্মঘরে মানুষ হইয়াছে এ কথা যাহাতে প্রকাশ না হইতে পারে সেজন্য চেষ্টা করিতে হইবে— অতএব এ কথা আর কাহাকেও জানাইবেন না। আগামী পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণে গঙ্গাস্নানের যোগ আছে, যদি সুবিধা পাই সেই সময়ে গিয়া কন্যা দেখিয়া আসিব।’
এতদিন কলিকাতায় কোনোপ্রকারে কাটিয়াছিল, কিন্তু শ্বশুরঘরে ফিরিবার আশা যেমনি একটু অঙ্কুরিত হইয়া উঠিল অমনি হরিমোহিনীর মন আর ধৈর্য মানিতে চাহিল না। নির্বাসনের প্রত্যেক দিন তাঁহার পক্ষে অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার ইচ্ছা করিতে লাগিল এখনই সুচরিতাকে বলিয়া দিন স্থির করিয়া কাজ সারিয়া ফেলি। তবু তাড়াতাড়ি করিতে তাঁহার সাহস হইল না। সুচরিতাকে যতই তিনি নিকটে করিয়া দেখিতেছেন ততই তিনি ইহা বুঝিতেছেন যে, তাহাকে তিনি বুঝিতে পারেন নাই।
হরিমোহিনী অবসর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন এবং পূর্বের চেয়ে সুচরিতার প্রতি বেশি করিয়া সতর্কতা প্রয়োগ করিলেন। আগে পূজাহ্নিকে তাঁহার যত সময় লাগিত এখন তাহা কমিয়া আসিবার উপক্রম হইল; তিনি সুচরিতাকে আর চোখের আড়াল করিতে চান না।
সুচরিতা দেখিল গোরার আসা হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেল। সে বুঝিল হরিমোহিনী তাঁহাকে কিছু বলিয়াছেন। সে কহিল, ‘আচ্ছা বেশ, তিনি নাই আসিলেন, কিন্তু তিনিই আমার গুরু, আমার গুরু!’
সম্মুখে যে গুরু তাহার চেয়ে অপ্রত্যক্ষ গুরুর জোর অনেক বেশি। কেননা, নিজের মন তখন গুরুর বিদ্যমানতার অভাব আপনার ভিতর হইতে পুরাইয়া লয়। গোরা সামনে থাকিলে সুচরিতা যেখানে তর্ক করিত এখন সেখানে গোরার রচনা পড়িয়া তাহার বাক্যগুলিকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করে। না বুঝিতে পারিলে বলে তিনি থাকিলে নিশ্চয় বুঝাইয়া দিতেন।
কিন্তু গোরার সেই তেজস্বী মূর্তি দেখিবার এবং তাহার সেই বজ্রগর্ভ মেঘগর্জনের মতো বাক্য শুনিবার ক্ষুধা কিছুতেই কি মিটিতে চায়! এই তাহার নিবৃত্তিহীন আন্তরিক ঔৎসুক্য একেবারে নিরন্তর হইয়া তাহার শরীরকে যেন ক্ষয় করিতে লাগিল। থাকিয়া থাকিয়া সুচরিতা অত্যন্ত ব্যথার সহিত মনে করে কত লোক অতি অনায়াসেই রাত্রিদিন গোরার দর্শন পাইতেছে, কিন্তু গোরার দর্শনের কোনো মূল্য তাহারা জানে না।
ললিতা আসিয়া সুচরিতার গলা জড়াইয়া ধরিয়া একদিন অপরাহ্নে কহিল, “ভাই সুচিদিদি!”