দাড়িগোঁফ-কামানো, চুড়িদার সাদা পায়জামা, চুড়িদার সাদা আচকান, সাদা মসলিনের পঞ্জাবী
কায়দার পাগড়ি, শুঁড়তোলা সাদা নাগরাজুতো, দেহটা যে ওজনের কণ্ঠস্বরটাও তেমনি।
সোমশংকর। ক্ষিতিশবাবু, বসতে পারি কি।
ক্ষিতিশ। নিশ্চয়।
সোমশংকর। আমার নাম সোমশংকর সিং। আপনার নাম শুনেছি মিস্ বাঁশরির কাছ থেকে। তিনি আপনার ভক্ত।
ক্ষিতিশ। বোঝা কঠিন। অন্তত ভক্তিটা অবিমিশ্র নয়। তার থেকে ফুলের অংশ ঝরে পড়ে, কাঁটাগুলো দিনরাত থাকে বিঁধে।
সোমশংকর। আমার দুর্ভাগ্য আপনার বই পড়বার অবকাশ পাই নি। তবু আমাদের এই বিশেষ দিনে আপনি এখানে এসেছেন, বড়ো কৃতজ্ঞ হলুম। কোনো এক সময়ে আমাদের শম্ভুগড়ে আসবেন, এই আশা রইল। জায়গাটা আপনার মতো সাহিত্যিকের দেখবার যোগ্য।
বাঁশরি। (পিছন থেকে এসে) ভুল বলছ, শংকর, যা চোখে দেখা যায় তা উনি দেখেন না। ভূতের পায়ের মতো ওঁর চোখ উলটো দিকে। সে কথা যাক। শংকর, ব্যস্ত হোয়ো না। এখানে আজ আমার নেমন্তন্ন ছিল না। ধরে নিচ্ছি, সেটা আমার গ্রহের ভুল নয়, গৃহকর্তাদেরই ভুল। সংশোধন করতে এলুম। আজ সুষমার সঙ্গে তোমার এন্গেজ্মেণ্টের দিন, অথচ এ সভায় আমি থাকব না এ হতেই পারে না। খুশি হও নি অনাহূত এসেছি বলে?
সোমশংকর। খুব খুশি হয়েছি, সে কি বলতে হবে।
বাঁশরি। সেই কথাটা ভালো করে বলবার জন্যে একটু বসো এখানে। ক্ষিতিশ,ঐ চাঁপাগাছটার তলায় কিছুক্ষণ অদ্বিতীয় হয়ে থাকো গে। আড়ালে তোমার নিন্দে করব না।
শংকর, সময় বেশি নেই, কাজের কথাটা সেরে এখনই ছুটি দেব। তোমার নূতন এন্গেজ্মেণ্টের রাস্তায় পুরোনো জঞ্জাল কিছু জমে আছে। সাফ করে ফেললে সুগম হবে পথ। এই নাও।
বাঁশরি রেশমের থলি থেকে একটা পান্নার কন্ঠী, হীরের ব্রেস্লেট, মুক্তোবসানো ব্রোচ বের করে দেখিয়ে আবার থলিতে পুরে সোমশংকরের কোলে ফেলে দিলে।
সোমশংকর। বাঁশি, তুমি জান, আমার মুখে কথা জোগায় না। যা বলতে পারলেম না তার মানে নিজে বুঝে নিয়ো।
বাঁশরি। সব কথাই আমার জানা, মানে আমি বুঝি। এখন যাও, তোমাদের সময় হল।
সোমশংকর। যেয়ো না, বাঁশি। ভুল বুঝো না আমাকে। আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। আমি জঙ্গলের মানুষ। শহরে এসে কলেজে পড়ার আরম্ভের মুখে প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা। সে দৈবের খেলা। তুমিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছিলে, তার দাম কিছুতেই শোধ হবে না। তুচ্ছ এই গয়নাগুলো।
বাঁশরি। আমার শেষ কথাটা শোনো, শংকর। আমার তখন প্রথম বয়েস, তুমি এসে পড়লে সেই নতুন-জাগা অরুণরঙের দিগন্তে। ডাক দিয়ে আলোয় আনলে যাকে তাকে লও বা না লও নিজে তো তাকে পেলুম। আত্মপরিচয় ঘটল। বাস্, দুই পক্ষে হয়ে গেল শোধবোধ। এখন দুজনেই অঋণী হয়ে আপন আপন পথে চললুম। আর কী চাই।