এক-একজন লোক স্বপ্নাবস্থায় নির্ভীকভাবে অত্যন্ত সংকটের পথ দিয়া চলিয়া যায়, মুহূর্তমাত্র চিন্তা করে না। অনেক জাগ্রত মানুষেরও তেমনি চিরস্বপ্নাবস্থা উপস্থিত হয়; কিছুমাত্র জ্ঞান থাকে না, বিপদের সংকীর্ণ পথ দিয়া নিশ্চিন্তমনে অগ্রসর হইতে থাকে, অবশেষে নিদারুণ সর্বনাশের মধ্যে গিয়া জাগ্রত হইয়া উঠে।
আমাদের ম্যাক্মোরান কোম্পানির হেডবাবুটিরও সেই দশা। শৈলবালা তাহার জীবনের মাঝখানে একটা প্রবল আবর্তের মতো ঘুরিতে লাগিল এবং বহু দূর হইতে বিবিধ মহার্ঘ্য পদার্থ আকৃষ্ট হইয়া তাহার মধ্যে বিলুপ্ত হইতে লাগিল। কেবল যে নিবারণের মনুষ্যত্ব এবং মাসিক বেতন, হরসুন্দরীর সুখসৌভাগ্য এবং বসনভূষণ, তাহা নহে; সঙ্গে সঙ্গে ম্যাক্মোরান কোম্পানির ক্যাশ্ তহবিলেও গোপনে টান পড়িল। তাহার মধ্য হইতেও দুটা-একটা করিয়া তোড়া অদৃশ্য হইতে লাগিল। নিবারণ স্থির করিত, ‘আগামী মাসের বেতন হইতে আস্তে আস্তে শোধ করিয়া রাখিব।’ কিন্তু আগামী মাসের বেতনটি হাতে আসিবামাত্র সেই আবর্ত হইতে টান পড়ে এবং শেষ দু-আনিটি পর্যন্ত চকিতের মতো চিক্ মিক্ করিয়া বিদ্যুদ্ বেগে অন্তর্হিত হয়।
শেষে একদিন ধরা পড়িল। পুরুষানুক্রমে চাকুরি। সাহেব বড়ো ভালোবাসে— তহবিল পূরণ করিয়া দিবার জন্য দুইদিন মাত্র সময় দিল।
কেমন করিয়া সে ক্রমে আড়াই হাজার টাকার তহবিল ভাঙিয়াছে তাহা নিবারণ নিজেই বুঝিতে পারিল না। একেবারে পাগলের মতো হইয়া হরসুন্দরীর কাছে গেল, বলিল, “সর্বনাশ হইয়াছে।”
হরসুন্দরী সমস্ত শুনিয়া একেবারে পাংশুবর্ণ হইয়া গেল।
নিবারণ কহিল, “শীঘ্র গহনাগুলো বাহির করো।”
হরসুন্দরী কহিল, “সে তো আমি সমস্ত ছোটোবউকে দিয়াছি।”
নিবারণ নিতান্ত শিশুর মতো অধীর হইয়া বলিতে লাগিল, “কেন দিলে ছোটো বউকে। কেন দিলে। কে তোমাকে দিতে বলিল।”
হরসুন্দরী তাহার প্রকৃত উত্তর না দিয়া কহিল, “তাহাতে ক্ষতি কী হইয়াছে। সে তো আর জলে পড়ে নাই।”
ভীরু নিবারণ কাতরস্বরে কহিল, “তবে যদি তুমি কোনো ছুতা করিয়া তাহার কাছ হইতে বাহির করিতে পার। কিন্তু আমার মাথা খাও, বলিয়ো না যে, আমি চাহিতেছি কিংবা কী জন্য চাহিতেছি।”
তখন হরসুন্দরী মর্মান্তিক বিরক্তি ও ঘৃণা-ভরে বলিয়া উঠিল, “এই কি তোমার ছলছুতা করিবার, সোহাগ দেখাইবার সময়। চলো।” বলিয়া স্বামীকে লইয়া ছোটোবউয়ের ঘরে প্রবেশ করিল।
ছোটোবউ কিছু বুঝিল না। সে সকল কথাতেই বলিল, “সে আমি কি জানি।”
সংসারের কোনো চিন্তা যে তাহাকে কখনো ভাবিতে হইবে এমন কথা কি তাহার সহিত ছিল। সকলে আপনার ভাবনা ভাবিবে এবং সকলে মিলিয়া শৈলবালার আরাম চিন্তা করিবে- অকস্মাৎ ইহার ব্যতিক্রম হয়, এ কী ভয়ানক অন্যায়।
তখন নিবারণ শৈলবালার পায়ে ধরিয়া কাঁদিয়া পড়িল। শৈলবালা কেবলই বলিল, “সে আমি জানি না। আমার জিনিস আমি কেন দিব।”