বিনোদিনী। আগে হইতে প্রস্তুত হইয়া আসিলে কিছু হয় না, অসাবধান থাকিতে হয়। কী বল, ভাই চোখের বালি। তোমার এই দেওরের ভার তুমিই লও-না, ভাই।
আশা তাহাকে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঠেলিয়া দিল। বিহারীও এ ঠাট্টায় যোগ দিল না।
আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো ঠাট্টা সহিবে না, এটুকু বিনোদিনীর কাছে এড়াইতে পারে নাই। বিহারী আশাকে শ্রদ্ধা করে এবং বিনোদিনীকে হালকা করিতে চায়, ইহা বিনোদিনীকে বিঁধিল।
সে পুনরায় আশাকে কহিল, “তোমার এই ভিক্ষুক দেওরটি আমাকে উপলক্ষ করিয়া তোমারই কাছে আদর ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে– কিছু দে, ভাই।”
আশা অত্যন্ত বিরক্ত হইল। ক্ষণকালের জন্য বিহারীর মুখ লাল হইল, পরক্ষণেই হাসিয়া কহিল, “আমার বেলাতেই কি পরের উপর বরাত চালাইবে, আর মহিনদার সঙ্গেই নগদ কারবার!”
বিহারী সমস্ত মাটি করিতে আসিয়াছে, বিনোদিনীর ইহা বুঝিতে বাকি রহিল না। বুঝিল, বিহারীর সম্মুখে সশস্ত্রে থাকিতে হইবে।
মহেন্দ্র বিরক্ত হইল। খোলসা কথায় কবিত্বের মাধুর্য নষ্ট হয়। সে ঈষৎ তীব্র স্বরেই কহিল, “বিহারী, তোমার মহিনদা কোনো কারবারে যান না– হাতে যা আছে, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।”
বিহারী। তিনি না যেতে পারেন, কিন্তু ভাগ্যে লেখা থাকিলে কারবারের ঢেউ বাহির হইতে আসিয়াও লাগে।
বিনোদিনী। আপনার উপস্থিত হাতে কিছুই নাই, কিন্তু আপনার ঢেউটা কোন্ দিক হইতে আসিতেছে!– বলিয়া সে সকটাক্ষহাস্যে আশাকে টিপিল। আশা বিরক্ত হইয়া উঠিয়া গেল। বিহারী পরাভূত হইয়া ক্রোধে নীরব হইল; উঠিবার উপক্রম করিতেই বিনোদিনী কহিল, “হতাশ হইয়া যাবেন না, বিহারীবাবু। আমি চোখের বালিকে পাঠাইয়া দিতেছি।”
বিনোদিনী চলিয়া যাইতেই সভাভঙ্গে মহেন্দ্র মনে মনে রাগিল। মহেন্দ্রের অপ্রসন্ন মুখ দেখিয়া বিহারীর রুদ্ধ আবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কহিল, “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করো– বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরলহৃদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না। এখনো বলিতেছি, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না।”
বলিতে বলিতে বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।
মহেন্দ্র রুদ্ধরোষে কহিল, “বিহারী, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হেঁয়ালি ছাড়িয়া স্পষ্ট কথা কও।”
বিহারী কহিল, “স্পষ্টই কহিব। বিনোদিনী তোমাকে ইচ্ছা করিয়া অধর্মের দিকে টানিতেছে এবং তুমি না জানিয়া মূঢ়ের মতো অপথে পা বাড়াইতেছ।”
মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিয়া কহিল, “মিথ্যা কথা। তুমি যদি ভদ্রলোকের মেয়েকে এমন অন্যায় সন্দেহের চোখে দেখ, তবে অন্তঃপুরে তোমার আসা উচিত নয়।”
এমন সময় একটি থালায় মিষ্টান্ন সাজাইয়া বিনোদিনী হাস্যমুখে তাহা বিহারীর সম্মুখে রাখিল। বিহারী কহিল, “এ কী ব্যাপার। আমার তো ক্ষুধা নাই।”
বিনোদিনী কহিল, “সে কি হয়। একটু মিষ্টমুখ করিয়া আপনাকে যাইতেই হইবে।”
বিহারী হাসিয়া কহিল, “আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হইল বুঝি। সমাদর আরম্ভ হইল।”
বিনোদিনী অত্যন্ত টিপিয়া হাসিল; কহিল, “আপনি যখন দেওর তখন সম্পর্কের যে জোর আছে। যেখানে দাবি করা চলে