আবার একদা বর্ষার দিনে জীর্ণ শরীর ও শূন্য হৃদয় লইয়া শশিভূষণ কারাপ্রাচীরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। স্বাধীনতা পাইলেন কিন্তু তাহা ছাড়া কারার বাহিরে তাঁহার আর-কেহ অথবা আর-কিছু ছিল না। গৃহহীন আত্মীয়হীন সমাজহীন কেবল তাঁহার একলাটির পক্ষে এত বড়ো জগৎ সংসার অত্যন্ত ঢিলা বলিয়া ঠেকিতে লাগিল।
জীবনযাত্রার বিচ্ছিন্ন সূত্র আবার কোথা হইতে আরম্ভ করিবেন এই কথা ভাবিতেছেন, এমন সময়ে এক বৃহৎ জুড়ি তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। একজন ভৃত্য নামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার নাম শশিভূষণবাবু? ”
তিনি কহিলেন, “হাঁ।”
সে তৎক্ষণাৎ গাড়ির দরজা খুলিয়া তাঁহার প্রবেশের প্রতীক্ষায় দাঁড়াইল।
তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে কোথায় যাইতে হইবে।”
সে কহিল, “আমার প্রভু আপনাকে ডাকিয়াছেন।”
পথিকদের কৌতূহলদৃষ্টিপাত অসহ্য বোধ হওয়াতে তিনি সেখানে আর অধিক বাদানুবাদ না করিয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলেন। ভাবিলেন, নিশ্চয় ইহার মধ্যে একটা কিছু ভ্রম আছে। কিন্তু একটা কোনো দিকে তো চলিতে হইবে— নাহয় এমনি করিয়া ভ্রম দিয়াই এই নূতন জীবনের ভূমিকা আরম্ভ হউক।
সেদিনও মেঘ এবং রৌদ্র আকাশময় পরস্পরকে শিকার করিয়া ফিরিতেছিল; পথের প্রান্তবর্তী বর্ষার জল-প্লাবিত গাঢ়শ্যাম শস্যক্ষেত্র চঞ্চল ছায়ালোকে বিচিত্র হইয়া উঠিতেছিল। হাটের কাছে একটা বৃহৎ রথ পড়িয়া ছিল এবং তাহার অদূরবর্তী মুদির দোকানে একদল বৈষ্ণব ভিক্ষুক গুপিযন্ত্র ও খোল করতাল-যোগে গান গাহিতেছিল—
এসো এসো ফিরে এসো— নাথ হে, ফিরে এসো!
আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত,
বঁধু হে, ফিরে এসো!
গাড়ি অগ্রসর হইয়া চলিল, গানের পদ ক্রমে দূর হইতে দূরতর হইয়া কানে প্রবেশ করিতে লাগিল—
আমার করুণ কোমল, এসো!
ওগো সজলজলস্নিগ্ধকান্ত সুন্দর, ফিরে এসো!
গানের কথা ক্রমে ক্ষীণতর অস্ফুটতর হইয়া আসিল, আর বুঝা গেল না। কিন্তু গানের ছন্দে শশিভূষণের হৃদয়ে একটা আন্দোলন তুলিয়া দিল, তিনি আপন মনে গুন্গুন্ করিয়া, পদের পর পদ রচনা করিয়া যোজনা করিয়া চলিলেন, কিছুতে যেন থামিতে পারিলেন না—
আমার চিরদুখ, ফিরে এসো!
আমার সব-সুখ-দুখ-মন্থন-ধন, অন্তরে ফিরে এসো!
আমার চিরবাঞ্ছিত, এসো!