যতীন কুড়ানির কপালে হাত দিয়া কহিল, “ তুমি কেমন বোধ করিতেছ, কুড়ানি। ”
কুড়ানি তাহার কোনো উত্তর না করিয়া যতীনের হাতটি আপনার কপালেই চাপিয়া রাখিয়া দিল।
যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “ ভালো বোধ হইতেছে? ”
কুড়ানি একটুখানি চোখ বুজিয়া কহিল, “ হাঁ। ”
যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “ তোমার গলায় এটা কী কুড়ানি। ”
কুড়ানি তাড়াতাড়ি কাপড়টা টানিয়া তাহা ঢাকিবার চেষ্টা করিল। যতীন দেখিল সে একগাছি শুকনো বকুলের মালা। তখন তাহার মনে পড়িল, সে মালাটা কী। ঘড়ির টিক্টিক্ শব্দের মধ্যে যতীন চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। কুড়ানির এই প্রথম লুকাইবার চেষ্টা- নিজের হৃদয়ের ভাব গোপন করিবার এই তাহার প্রথম প্রয়াস। কুড়ানি মৃগশিশু ছিল, সে কখন হৃদয়ভারাতুর যুবতী নারী হইয়া উঠিল। কোন্ রৌদ্রের আলোকে, কোন্ রৌদ্রের উত্তাপে তাহার বুদ্ধির উপরকার সমস্ত কুয়াশা কাটিয়া গিয়া তাহার লজ্জা, তাহার শঙ্কা, তাহার বেদনা এমন হঠাৎ প্রকাশিত হইয়া পড়িল।
রাত্রি দুটা-আড়াইটার সময় যতীন চৌকিতে বসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ দ্বার খোলার শব্দে চমকিয়া উঠিয়া দেখিল, পটল এবং হরকুমারবাবু এক বড়ো ব্যাগ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।
হরকুমার কহিলেন, “ তোমার চিঠি পাইয়া কাল সকালে আসিব বলিয়া বিছানায় শুইলাম। অর্ধেক রাত্রে পটল কহিল, ‘ ওগো, কাল সকালে গেলে কুড়ানিকে দেখিতে পাইব না — আমাকে এখনই যাইতে হইবে। ' পটলকে কিছুতেই বুঝাইয়া রাখা গেল না, তখনই একটা গাড়ি করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছি। ”
পটল হরকুমারকে কহিল, “ চলো, তুমি যতীনের বিছানায় শোবে চলো। ”
হরকুমার ঈষৎ আপত্তির আড়ম্বর করিয়া যতীনের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িলেন, তাঁহার নিদ্রা যাইতেও দেরি হইল না।
পটল ফিরিয়া আসিয়া যতীনকে ঘরের এক কোণে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ আশা আছে? ”
যতীন কুড়ানির কাছে আসিয়া তাহার নাড়ি দেখিয়া মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইল যে, আশা নাই।
পটল কুড়ানির কাছে আপনাকে প্রকাশ না করিয়া যতীনকে আড়ালে লইয়া কহিল, “ যতীন, সত্য বলো, তুমি কি কুড়ানিকে ভালোবাস না। ”
যতীন পটলকে কোনো উত্তর না দিয়া কুড়ানির বিছানার পাশে আসিয়া বসিল। তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, “ কুড়ানি, কুড়ানি। ”
কুড়ানি চোখ মেলিয়া মুখে একটি শান্ত মধুর হাসির আভাসমাত্র আনিয়া কহিল, “ কী, দাদাবাবু। ”
যতীন কহিল, “ কুড়ানি, তোমার এই মালাটি আমার গলায় পরাইয়া দাও। ”
কুড়ানি অনিমেষ অবুঝ চোখে যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
যতীন কহিল, “ তোমার মালা আমাকে দিবে না? ”
যতীনের এই আদরের প্রশ্নটুকু পাইয়া কুড়ানির মনে পূর্বকৃত অনাদরের একটুখানি অভিমান জাগিয়া উঠিল। সে কহিল, “ কী হবে, দাদাবাবু। ”
যতীন দুই হাতে তাহার হাত লইয়া কহিল, “ আমি তোমাকে ভালোবাসি, কুড়ানি। ”
শুনিয়া ক্ষণকালের জন্য কুড়ানি স্তব্ধ রহিল ; তাহার পরে তাহার দুই চক্ষু দিয়া অজস্র জল পড়িতে লাগিল। যতীন বিছানার পাশে নামিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিল, কুড়ানির হাতের কাছে মাথা নত করিয়া রাখিল। কুড়ানি গলা হইতে মালা খুলিয়া যতীনের