
আনন্দময়ী বিনয়ের মনের ভাবটা বুঝিলেন। তিনি অন্য দিকে তাহার মনকে ফিরাইবার জন্য বলিলেন, “কাল গোরার চিঠি পেয়েছি বিনয়।”
বিনয় একটু অন্যমনস্ক ভাবেই কহিল, “কি লিখেছে?”
আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের খবর বড়ো একটা কিছু দেয় নি। দেশের ছোটোলোকদের দুর্দশা দেখে দুঃখ করে লিখেছে। ঘোষপাড়া বলে কোন্-এক গ্রামে ম্যাজিস্ট্রেট কী সব অন্যায় করেছে তারই বর্ণনা করেছে।”
গোরার প্রতি একটা বিরুদ্ধ ভাবের উত্তেজনা হইতেই অসহিষ্ণু হইয়া বিনয় বলিয়া উঠিল, “গোরার ঐ পরের দিকেই দৃষ্টি, আর আমরা সমাজের বুকের উপরে বসে প্রতিদিন যে-সব অত্যাচার করছি তা কেবলই মার্জনা করতে হবে, আর বলতে হবে এমন সৎকর্ম আর কিছু হতে পারে না।”
হঠাৎ গোরার উপরে এইরূপ দোষারোপ করিয়া বিনয় যেন অন্য পক্ষ বলিয়া নিজেকে দাঁড় করাইল দেখিয়া আনন্দময়ী হাসিলেন।
বিনয় কহিল, “মা, তুমি হাসছ, মনে করছ হঠাৎ বিনয় এমন রাগ করে উঠল কেন? কেন রাগ হয় তোমাকে বলি। সুধীর সেদিন আমাকে তাদের নৈহাটি স্টেশনে তার এক বন্ধুর বাগানে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা শেয়ালদা ছাড়তেই বৃষ্টি আরম্ভ হল। সোদপুর স্টেশনে যখন গাড়ি থামল দেখি, একটি সাহেবি-কাপড়-পরা বাঙালি নিজে মাথায় দিব্যি ছাতা দিয়ে তার স্ত্রীকে গাড়ি থেকে নাবালে। স্ত্রীর কোলে একটি শিশু ছেলে; গায়ের মোটা চাদরটা দিয়ে সেই ছেলেটিকে কোনোমতে ঢেকে খোলা স্টেশনের এক ধারে দাঁড়িয়ে সে বেচারি শীতে ও লজ্জায় জড়সড় হয়ে ভিজতে লাগল— তার স্বামী জিনিসপত্র নিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁকডাক বাধিয়ে দিলে। আমার এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, সমস্ত বাংলাদেশে কি রৌদ্রে কি বৃষ্টিতে কি ভদ্র কি অভদ্র কোনো স্ত্রীলোকের মাথায় ছাতা নেই। যখন দেখলুম স্বামীটা নির্লজ্জভাবে মাথায় ছাতা দিয়েছে, আর তার স্ত্রী গায়ে চাদর ঢাকা দিয়ে নীরবে ভিজছে, এই ব্যবহারটাকে মনে মনেও নিন্দা করছে না এবং স্টেশনসুদ্ধ কোনো লোকের মনে এটা কিছুমাত্র অন্যায় বলে বোধ হচ্ছে না, তখন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি— আমরা স্ত্রীলোকদের অত্যন্ত সমাদর করি— তাদের লক্ষ্মী বলে, দেবী বলে জানি, এ-সমস্ত অলীক কাব্যকথা আর কোনোদিন মুখেও উচ্চারণ করব না। আমরা দেশকে বলি মাতৃভূমি, কিন্তু দেশের সেই নারীমূর্তির মহিমা দেশের স্ত্রীলোকের মধ্যে যদি প্রত্যক্ষ না করি— বুদ্ধিতে, শক্তিতে, কর্তব্যবোধের ঔদার্যে আমাদের মেয়েদের যদি পূর্ণ পরিণত সতেজ সবল ভাবে আমরা না দেখি— ঘরের মধ্যে দুর্বলতা সংকীর্ণতা এবং অপরিণতি যদি দেখতে পাই— তা হলে কখনোই দেশের উপলব্ধি আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না।”
নিজের উৎসাহে হঠাৎ লজ্জিত হইয়া বিনয় স্বাভাবিক সুরে কহিল, “মা, তুমি ভাবছ বিনয় মাঝে মাঝে এইরকম বড়ো বড়ো কথায় বক্তৃতা করে থাকে— আজও তাকে বক্তৃতায় পেয়েছে। অভ্যাসবশত আমার কথাগুলো বক্তৃতার মতো হয়ে পড়ে, আজ এ আমার কিন্তু বক্তৃতা নয়। দেশের মেয়েরা যে দেশের কতখানি আগে আমি তো ভালো করে বুঝতেই পারি নি, কখনো চিন্তাও করি নি। মা, আর বেশি বকব না। আমি বেশি কথা কই বলে আমার কথাকে কেউ আমারই মনের কথা বলে বিশ্বাস করে না। এবার থেকে কথা কমাব।”
বলিয়া বিনয় আর বিলম্ব না করিয়া উৎসাহদীপ্ত চিত্তে প্রস্থান করিল।
আনন্দময়ী মহিমকে ডাকাইয়া বলিলেন, “বাবা, বিনয়ের সঙ্গে আমাদের শশিমুখীর বিবাহ হবে না।”
মহিম। কেন? তোমার অমত আছে?