বাড়ির ডাক্তার অনাদি আসিয়া মাখনকে কহিলেন, “দাদা, করছ কী। মেয়েটা যে মারা যাবে।”
মাখন উদ্বিগ্ন মুখে বলিলেন, “তাই তো, কী করি।”
ষোড়শীর কাছে তাঁর আর সাহস নাই। এক সময়ে অত্যন্ত মৃদুস্বরে তাকে আসিয়া বলিলেন, “মা, এত অনিয়মে কি তোমার শরীর টিকবে।”
ষোড়শী একটুখানি হাসিল। তার মর্মার্থ এই, এমন-সকল বৃথা উদ্বেগ সংসারী বিষয়ী লোকেরই যোগ্য বটে।
বরদা চলিয়া যাওয়ার পরে বারো বৎসর পার হইয়া গেছে; এখন ষোড়শীর বয়স পঁচিশ। একদিন ষোড়শী তার যোগী শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, আমার স্বামী জীবিত আছেন কি না, তা আমি কেমন করে জানব।”
যোগী প্রায় দশ মিনিট কাল স্তব্ধ হইয়া চোখ বুজিয়া রহিলেন; তার পরে চোখ খুলিয়া বলিলেন, “জীবিত আছেন।”
“কেমন ক’রে জানলেন।”
“সে কথা এখনো তুমি বুঝবে না। কিন্তু, এটা নিশ্চয় জেনো, স্ত্রীলোক হয়েও সাধনার পথে তুমি যে এতদূর অগ্রসর হয়েছ সে কেবল তোমার স্বামীর অসামান্য তপোবলে। তিনি দূরে থেকেও তোমাকে সহধর্মিণী ক’রে নিয়েছেন।”
ষোড়শীর শরীর মন পুলকিত হইয়া উঠিল। নিজের সম্বন্ধে তার মনে হইল, ঠিক যেন শিব তপস্যা করিতেছেন আর পার্বতী পদ্মবীজের মালা জপিতে জপিতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করিয়া আছেন।
ষোড়শী আবার জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি কোথায় আছেন তা কি জানতে পারি।”
যোগী ঈষৎ হাস্য করিলেন; তার পরে বলিলেন, “একখানা আয়না নিয়ে এসো।”
ষোড়শী আয়না আনিয়া যোগীর নির্দেশমত তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল।
আধ ঘণ্টা গেলে যোগী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু দেখতে পাচ্ছ?”
ষোড়শী দ্বিধার স্বরে কহিল, “হাঁ যেন কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কী তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি নে।”
“সাদা কিছু দেখছ কি।”
“সাদাই তো বটে।”
“যেন পাহাড়ের উপর বরফের মতো?”
“নিশ্চয়ই বরফ! কখনো পাহাড় তো দেখি নি, তাই এতক্ষণ ঝাপসা ঠেকছিল।”
এইরূপ আশ্চর্য উপায়ে ক্রমে ক্রমে দেখা গেল, বরদা হিমালয়ের অতি দুর্গম জায়গায় লংচু পাহাড়ে বরফের উপর অনাবৃত দেহে বসিয়া আছেন। সেখান হইতে তপস্যার তেজ ষোড়শীকে আসিয়া স্পর্শ করিতেছে, এই এক আশ্চর্য কাণ্ড।
সেদিন ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া ষোড়শীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। তার স্বামীর তপস্যা যে তাকে দিনরাত ঘেরিয়া আছে, স্বামী কাছে থাকিলে মাঝে মাঝে যে বিচ্ছেদ ঘটিতে পারিত সে বিচ্ছেদও যে তার নাই, এই আনন্দে তার মন ভরিয়া উঠিল। তার মনে হইল, সাধনা আরো অনেক বেশি কঠোর হওয়া চাই। এতদিন এবং পৌষ মাসটাতে যে কম্বল সে গায়ে দিতেছিল