“মাসি, ঘড়িতে কটা বেজেছে।”
“নটা বাজবে।”
“সবে নটা? আমি ভাবছিলুম, বুঝি দুটো, তিনটে, কি কটা হবে। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপুর রাত আরম্ভ হয়। তবে তুমি আমার ঘুমের জন্যে অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন।”
“কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না,তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি।”
“মণি কি ঘুমিয়েছে।”
“না, সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক’রে তবে ঘুমোতে যায়।”
“বলো কী, মাসি, মণি কি তবে—”
“সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে।”
“আমি ভাবতুম,মণি বুঝি –”
“মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয়। দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয়।”
“আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝোল হয়েছিল তাতে বড়ো সুন্দর একটি তার ছিল। আমি ভাবছিলুম, তোমারই হাতের তৈরি।”
“কপাল আমার! মণি কি আমাকে কিছু করতে দেয়। তোমার গামছা তোয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে। জানে যে, কোথাও কিছু নোংরা তুমি দেখতে পার না। তোমার বাইরের বৈঠকখানা যদি ঐকবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্তকে ক’রে রেখে দিয়েছে ; আমি যদি তোমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত! ও তো তাই চায়।”
“মণির শরীরটা বুঝি –”
“ডাক্তাররা বলে রোগীর ঘরে ওকে সর্বদা অনাগোনা করতে দেওয়া কিছু নয়। ওর মন বড়ো নরম কি না, তোমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে।”
“মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী ক’রে।”
“আমাকে ও বড্ডো মানে বলেই পারি। তবু বার বার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয়— ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে।”
আকাশের তারাগুলি যেন করুণা-বিগলিত চোখের জলের মতো জ্বল্জ্বল্ করিতে লাগিল। যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল— এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রোগক্লান্ত হাতটি রাখিল।
একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উস্খুস্ করিয়া যতীন বলিল , “মাসি, মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে—”
“এখনি ডেকে দিচ্ছি, বাবা।”
“আমি বেশিক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে— কেবল পাঁচ মিনিট— দুটো একটা কথা যা বলবার আছে—”
মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন। এদিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল। যতীন জানে, আজ পর্যন্ত