সোমশংকর। বাঁশি, যদি কিছু বলতে যাই নির্বোধের মতো বলব। বুঝলুম, আমার আসল কথাটা বলা হবে না কোনোদিনই। আচ্ছা, তবে থাক্। অমন চুপ করে আমার দিকে চেয়ে আছ কেন। মনে হচ্ছে, দুই চোখ দিয়ে আমাকে লুপ্ত করে দেবে।
বাঁশরি। আমি তাকিয়ে দেখছি একশো বছর পরেকার যুগান্তে। সে-দিকে আমি নেই, তুমি নেই, আজকের দিনের অন্য কেউ নেই। ভুল বোঝার কথা বলছ! সেই ভুল বোঝার উপর দিয়ে চলে যাবে কালের রথ। ধুলো হয়ে যাবে, সেই ধুলোর উপরে বসে খেলা করবে তোমার নাতি-নাতনিরা। সেই নির্বিকার ধুলোর হোক জয়।
সোমশংকর। এ গয়নাগুলোর কোথাও স্থান রইল না; যাক তবে।
ফ্রক পরা, চশমা চোখে, বেণী দোলানো, দ্রুতপদে-চলা এগারো বছরের মেয়ে।
সুষীমা। সন্ন্যাসীবাবা আসছেন, শংকরদা। তোমাকে ডেকে পাঠালেন সবাই। তুমি আসবে না, বাঁশিদিদি?
বাঁশরি। আসব বইকি, আসার সময় হোক আগে।
ক্ষিতিশ, শুনে যাও। চোখ আছে। দেখতে পাচ্ছ কিছু কিছু?
ক্ষিতিশ। রঙ্গভূমির বাইরে আমি। আওয়াজ পাচ্ছি, রাস্তা পাচ্ছি নে।
বাঁশরি। বাংলা উপন্যাসে নিয়ুমার্কেটের রাস্তা খুলেছ নিজের জোরে, আলকাতরা ঢেলে। এখানে পুতুলনাচের রাস্তাটা বের করতে তোমারও অফীসিয়াল গাইড চাই! লোকে হাসবে যে!
ক্ষিতিশ। হাসুক-না। রাস্তা না পাই, অমন গাইডকে তো পাওয়া গেল।
বাঁশরি। রসিকতা! সস্তা মিষ্টান্নের ব্যাবসা! এজন্যে ডাকি নি তোমাকে। সত্যি করে দেখতে শেখো, সত্যি করে লিখতে শিখবে। চারি দিকে অনেক মানুষ আছে, অনেক অমানুষও আছে, ঠাহর করলেই চোখে পড়বে। দেখো দেখো, ভালো করে দেখো।
ক্ষিতিশ। নাই বা দেখলেম, তোমার তাতে কী।
বাঁশরি। নিজে লিখতে পারি নে যে, ক্ষিতিশ। চোখে দেখি, মনে বুঝি, স্বর বন্ধ, ব্যর্থ হয় যে সব। ইতিহাসে বলে, একদিন বাঙালি কারিগরদের বুড়ো আঙুল দিয়েছিল কেটে। আমিও কারিগর, বিধাতা বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছেন। আমদানি-করা মালে কাজ চালাই, পরখ করে দেখতে হয় সেটা সাঁচ্চা কি না। তোমরা লেখক, আমাদের মতো কলমহারাদের জন্যেই কলমের কাজ তোমাদের।
সুষমা। (ক্ষিতিশকে নমস্কার করে) বাঁশি, কোণে লুকিয়ে কেন।
বাঁশরি। কুনো সাহিত্যিককে বাইরে আনবার জন্য। খনির সোনাকে শানে চড়িয়ে তার চেকনাই বের করতে পারি, আগে থাকতেই হাতযশ আছে। জহরতকে দামী করে তোলে জহরী, পরের ভোগেরই জন্য, কী বল। সুষী, ইনিই ক্ষিতিশবাবু, জান বোধ হয়।