তিন তরুণ সভ্য অক্ষয়কে নমস্কার করিল। বিপিন ও শ্রীশ দুই বন্ধু সদ্যোবিবাদের বিমর্ষতায় গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিল। পূর্ণ কহিল, “মশায়, অভূতপূর্বর চেয়ে ভূতপূর্বকেই বেশি ভয় হয়।”
অক্ষয় কহিলেন, “পূর্ণবাবু বুদ্ধিমানের মতো কথাই বলেছেন। সংসারে ভূতের ভয়টাই প্রচলিত। নিজে যে ব্যক্তি ভূত অন্যলোকের জীবনসম্ভোগটা তার কাছে বাঞ্ছনীয় হতে পারেই না, এই মনে করে মানুষ ভূতকে ভয়ংকর কল্পনা করে। অতএব সভাপতিমশায়, চিরকুমার-সভার ভূতটিকে সভা থেকে ঝাড়াবেন না পূর্ব-সম্পর্কের মমতাবশত একখানা চৌকি দেবেন, এইবেলা বলুন।”
“চৌকি দেওয়াই স্থির” বলিয়া চন্দ্রবাবু একখানি চেয়ার অগ্রসর করিয়া দিলেন।
“সর্বসম্মতিক্রমে আসন গ্রহণ করলুম” বলিয়া অক্ষয়বাবু বসিলেন; বলিলেন, “আপনারা আমাকে নিতান্ত ভদ্রতা করে বসতে বললেন বলেই যে আমি অভদ্রতা করে বসেই থাকব আমাকে এমন অসভ্য মনে করবেন না– বিশেষত পান তামাক এবং পত্নী আপনাদের সভার নিয়মবিরুদ্ধ, অথচ ঐ তিনটে বদ অভ্যাসই আমাকে একেবারে মাটি করেছে, সুতরাং চট্পট্ কাজের কথা সেরেই বাড়িমুখো হতে হবে।”
চন্দ্রবাবু হাসিয়া কহিলেন, “আপনি যখন সভ্য নন তখন আপনার সম্বন্ধে সভার নিয়ম না-ই খাটালেম– পান-তামাকের বন্দোবস্ত বোধ হয় করে দিতে পারব, কিন্তু আপনার তৃতীয় নেশাই– ”
অক্ষয়। সেটি এখানে বহন করে আনবার চেষ্টা করবেন না, আমার সে নেশাটি প্রকাশ্য নয়!
চন্দ্রবাবু পান-তামাকের জন্য সনাতন চাকরকে ডাকিবার উপক্রম করিলেন। পূর্ণ কহিল, “আমি ডাকিয়া দিতেছি।” বলিয়া উঠিল; পাশের ঘরে চাবি এবং চুড়ি এবং সহসা পলায়নের শব্দ একসঙ্গে শোনা গেল।
অক্ষয় তাহাকে থামাইয়া কহিলেন, “যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ। যতক্ষণ আমি এখানে আছি ততক্ষণ আমি আপনাদের চিরকুমার– কোনো প্রভেদ নেই। এখন আমার প্রস্তাবটা শুনুন।”
চন্দ্রবাবু টেবিলের উপর কার্যবিবরণের খাতাটির প্রতি অত্যন্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া মন দিয়া শুনিতে লাগিলেন।
অক্ষয় কহিলেন, “আমার কোনো মফস্বলের ধনী বন্ধু তাঁর একটি সন্তানকে আপনাদের কুমারসভার সভ্য করতে ইচ্ছা করেছেন।”
চন্দ্রবাবু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “বাপ ছেলেটির বিবাহ দিতে চান না!”
অক্ষয়। সে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন– বিবাহ সে কোনোক্রমেই করবে না, আমি তার জামিন রইলুম। তার দূরসম্পর্কের এক দাদাসুদ্ধ সভ্য হবেন। তাঁর সম্বন্ধেও আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, কারণ যদিচ তিনি আপনাদের মতো সুকুমার নন, কিন্তু আপনাদের সকলের চেয়ে বেশি কুমার, তাঁর বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে– সুতরাং তাঁর সন্দেহের বয়সটা আর নেই, সৌভাগ্যক্রমে সেটা আপনাদের সকলেরই আছে।
অক্ষয়বাবুর প্রস্তাবে চিরকুমার-সভা প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। সভাপতি কহিলেন, “সভ্যপদপ্রার্থীদের নাম ধাম বিবরণ– ”
অক্ষয়। অবশ্যই তাঁদের নাম ধাম বিবরণ একটা আছেই– সভাকে তার থেকে বঞ্চিত করতে পারা যাবে না– সভ্য যখন পাবেন তখন নাম ধাম বিবরণ-সুদ্ধই পাবেন। কিন্তু আপনাদের এই একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরটি স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয়; আপনাদের এই চিরকুমার ক’টির চিরত্ব যাতে হ্রাস না হয় সে দিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন।
চন্দ্রবাবু কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া খাতাটি নাকের কাছে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনি জানেন তো আমাদের আয়– ”