নবীন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সেই স্ত্রীলোকটি যে শ্যামাসুন্দরী এইটে কোনোমতে খাড়া করতে পারলে আর ভাবনা নেই। মধুসূদন নাম চায়। শাস্ত্রী তখন বর্ণমালার বর্গ শুরু করলে। ‘ক’বর্গ শব্দটা বলে যেন অদৃশ্য ভৃগুমুনির দিকে কান পেতে রইল— কটাক্ষে দেখতে লাগল মধুসূদনের দিকে।‘ক’বর্গ শুনেই মধুসূদনের মুখে ঈষৎ একটু চমক দিলে। ও দিকে পিছন থেকে ‘না’ সংকেত করে নবীন ডাইনে বাঁয়ে লাগাল ঘাড়-নাড়া। নবীনের জানাই নেই যে মাদ্রাজে এ সংকেতের উলটো মানে। বেঙ্কটস্বামীর আর সন্দেহ রইল না— জোরগলায় বললে, ‘ক’বর্গ। মধুসূদনের মুখ দেখে ঠিক বুঝেছিল ‘ক’বর্গের প্রথম বর্ণটাই। তাই কথাটাকে আরো একটু ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রী বললে, এই কয়ের মধ্যেই মধুসূদনের সমস্ত কু।
এর পরে পুরো নাম জানবার জন্যে পীড়াপীড়ি না করে ব্যগ্র হয়ে মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “এর প্রতিকার?”
বেঙ্কটস্বামী গম্ভীরভাবে বলে দিলে, “কণ্টকেনৈব কণ্টকং— অর্থাৎ উদ্ধার করবে অন্য একজন স্ত্রীলোক।”
মধুসূদন চকিত হয়ে উঠল। বেঙ্কটস্বামী মানবচরিত্রবিদ্যার চর্চা করেছে।
নবীন অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “স্বামীজি, ঘোড়দৌড়ে মহারাজার ঘোড়াটা কি জিতেছে?”
বেঙ্কটস্বামী জানে অধিকাংশ ঘোড়াই জেতে না, একটু হিসাবের ভান করে বলে দিলে, “লোকসান দেখতে পাচ্ছি।”
কিছুকাল আগেই মধুসূদনের ঘোড়া মস্ত জিত জিতেছে। মধুসূদনকে কোনো কথা বলবার সময় না দিয়ে মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ করে নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “স্বামীজি, আমার কন্যাটার কী গতি হবে?” বলা বাহুল্য, নবীনের কন্যা নেই।
বেঙ্কটস্বামী নিশ্চয় ঠাওরালে পাত্র খুঁজছে। নবীনের চেহারা দেখেই বুঝলে, মেয়েটি অপ্সরা নয়। বলে দিলে, পাত্র শীঘ্র মিলবে না, অনেক টাকা ব্যয় করতে হবে।
মধুসূদনকে একটু অবসর না দিয়ে পরে পরে দশ-বারোটা অসংগত প্রশ্নের অদ্ভুত উত্তর বের করে নিয়ে নবীন বললে, “দাদা, আর কেন? এখন চলো।”
গাড়িতে উঠেই নবীন বলে উঠল, “দাদা, ওর সমস্ত চালাকি। ভণ্ড কোথাকার!”
“কিন্তু সেদিন যে— ”
“সেদিন ও আগে থাকতে খবর নিয়েছিল।”
“কেমন করে জানলে যে আমি আসব?”
“আমারই বোকামি। ঘাট হয়েছে ওর কাছে তোমাকে এনেছিলুম।”
জ্যোতিষীর প্রতারণার প্রমাণ যতই পাক, ‘ক’বর্গের কু মধুসূদনের মনে বিঁধে রইল। ভেবে দেখলে যে, নক্ষত্র অনাদর করে খুচরো প্রশ্নের যা তা জবাব দেয়, কিন্তু আদত প্রশ্নের জবাবে ভুল হয় না। মধুসূদন যার প্রত্যাশাই করে নি সেই দুঃসময় ওর বিবাহের সঙ্গে সঙ্গেই এল। এর চেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ কী হবে?
নবীন আস্তে আস্তে কথা পাড়ল, “দাদা, দুই সপ্তাহ তো কেটে গেল, এইবার বউরানীকে আনিয়ে নিই।”
“কেন, তাড়া কিসের? দেখো নবীন, তোমাকে বলে রাখলুম আর কখনোই এ-সব কথা আমার কাছে তুলবে না। যেদিন আমার খুশি আমি আনিয়ে নেব।”
নবীন দাদাকে চেনে, বুঝলে ও কথাটা খতম হয়ে গেল।
তবু সাহস করে জিজ্ঞাসা করলে, “মেজোবউ যদি বউরানীকে দেখতে যায় তা হলে কি দোষ আছে?”