কুমুর বড়ো ইচ্ছে হল হাবলুকে কিছু দেয়, খাবার কিংবা খেলার জিনিস। কিন্তু দেবার মতো কিছু নেই, তাই ওকে চুমো খেয়ে বললে, “আজ শুতে যাও, লক্ষ্মী ছেলে, কাল দুপুরবেলা তোমাকে বাজনা শোনাব।”
হাবলু করুণ মুখে উঠে মায়ের সঙ্গে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরেই মোতির মা ফিরে এল। নবীনের ষড়যন্ত্রের কী ফল হল তাই জানবার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে। কুমুর কাছে বসেই চোখে পড়ল, তার হাতে সেই নীলার আংটি। বুঝলে যে কাজ হয়েছে। কথাটা উত্থাপন করবার উপলক্ষ স্বরূপ বললে, “দিদি, তোমার এই বাজনাটা পেলে কেমন করে?”
কুমু বললে, “দাদা পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
“বড়োঠাকুর তোমাকে এনে দিলেন বুঝি?”
কমু সংক্ষেপে বললে, “হাঁ।”
মোতির মা কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে উল্লাস বা বিস্ময়ের চিহ্ন খুঁজে পেলে না।
“তোমার দাদার কথা কিছু বললেন কি?”
“না।”
“পরশু তিনি তো আসবেন, তাঁর কাছে তোমার যাবার কথা উঠল না?” “না, দাদার কোনো কথা হয় নি।”
“তুমি নিজেই চাইলে না কেন দিদি?”
“আমি ওঁর কাছে আর যা-কিছু চাই নে কেন, এটা পারব না।”
“তোমার চাবার দরকার হবে না, তুমি অমনিই ওঁর কাছে চলে যেয়ো। বড়োঠাকুর কিছুই বলবেন না।”
মোতির মা এখনো একটা কথা সম্পূর্ণ বুঝতে পারে নি যে, মধুসূদনের অনুকূলতা কুমুর পক্ষে সংকট
হয়ে উঠেছে; এর বদলে মধুসূদন যা চায় তা ইচ্ছে করলেও কুমু দিতে পারে না। ওর হৃদয় হয়ে গেছে দেউলে। এইজন্যেই মধূসূদনের কাছে দান গ্রহণ করে ঋণ বাড়াতে এত সংকোচ। কুমুর এমনও মনে হয়েছে যে, দাদা যদি আর কিছুদিন দেরি করে আসে তো সেও ভালো।
একটু অপেক্ষা করে থেকে মোতির মা বললে, “আজ মনে হল বড়োঠাকুরের মন যেন প্রসন্ন।”
সংশয়ব্যাকুল চোখে কুমু মোতির মার মুখে তাকিয়ে বললে, “এ প্রসন্নতা কেন ঠিক বুঝতে পারি নে, তাই আমার ভয় হয়; কী করতে হবে ভেবে পাই নে।”
কুমুর চিবুক ধরে মোতির মা বললে, “কিছুই করতে হবে না; এটুকু বুঝতে পারছ না, এতদিন উনি কেবল কারবার করে এসেছেন, তোমার মতো মেয়েকে কোনোদিন দেখেন নি। একটু একটু করে যতই চিনছেন ততই তোমার আদর বাড়ছে।”
“বেশি দেখলে বেশি চিনবেন, এমন কিছুই আমার মধ্যে নেই ভাই। আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি আমার ভিতরটা শূন্য। সেই ফাঁকটাই দিনে দিনে ধরা পড়বে। সেইজন্যেই হঠাৎ যখন দেখি উনি খুশি হয়েছেন, আমার মনে হয় উনি বুঝি ঠকেছেন। যেই সেটা ফাঁস হবে সে-ই আরো রেগে উঠবেন। সেই রাগটাই যে সত্য, তাই তাকে আমি তেমন ভয় করি নে।”
“তোমার দাম তুমি কী জান দিদি! যেদিন এদের বাড়িতে এসেছ, সেইদিনই তোমার পক্ষ থেকে যা দেওয়া হল, এরা সবাই মিলে তা শুধতে পারবে না। আমার কর্তাটি তো একেবারে মরিয়া, তোমার জন্যে সাগর লঙ্ঘন না করতে পারলে স্থির থাকতে পারছেন না। আমি যদি তোমাকে না ভালোবাসতুম তবে এই নিয়ে ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে যেত।”
কুমু হাসলে, বললে, “কত ভাগ্যে এমন দেবর পেয়েছি।”