কুটিরে রুগ্ণা মাতা অনাহারে শয্যাগত। সমস্ত দিন বালিকা এক মুষ্টিও আহার করিতে পায় নাই, প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথে পথে ভ্রমণ করিতেছে। সাহস করিয়া ভীতিবিহ্বলা বালা কাহারও কাছে ভিক্ষা চাহিতে পারে নাই— বালিকা কখনও ভিক্ষা করে নাই, কী করিয়া ভিক্ষা করিতে হয় জানে না, কাহাকে কী বলিতে হয় জানে না। আলুলিত কুন্তলরাশির মধ্যে সেই ক্ষুদ্র করুণ মুখখানি দেখিলে, দারুণ শীত কম্পমান তাহার সেই ক্ষুদ্র দেহখানি দেখিলে, পাষাণও বিগলিত হইত।
ক্রমে অন্ধকার ঘনীভূত হইল। নিরাশ বালিকা ভগ্নহৃদয়ে শূন্য অঞ্চলে কুটিরে ফিরিয়া যাইতেছে— কিন্তু অসাড় পা আর উঠে না; অনাহারে দুর্বল, পথশ্রমে ক্লান্ত, নিরাশায় ম্রিয়মাণ, শীতে অবসন্ন বালিকা আর চলিতে পারে না, অবশ হইয়া পথপ্রান্তে তুষারশয্যায় শুইয়া পড়িল। শরীর ক্রমে আরও অবসন্ন হইতে লাগিল। বালিকা বুঝিল ক্রমে সে অবসন্ন হইয়া তুষারে চাপা পড়িয়া মরিবে। মাকে স্মরণ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল; জোড়হস্তে কহিল, “মা ভগবতী, আমাকে মারিয়া ফেলিয়ো না, আমাকে রক্ষা করো, আমি মরিলে যে আমার মা কাঁদিবে, আমার অমর কাঁদিবে।”
ক্রমে বালিকা অচেতন হইয়া পড়িল। কমল আলুলিতকুন্তলে শিথিল-অঞ্চলে তুষারে অর্ধমগ্না হইয়া বৃক্ষচ্যুত মলিন ফুলটির মতো পথপ্রান্তে পড়িয়া রহিল। তুষারের উপর তুষার পড়িতে লাগিল, বালিকার বক্ষের উপর তুষারের কণা পড়িতেছে ও গলিতেছে। এবং ক্রমে জমিয়া যাইতেছে। এই আঁধার রাত্রিতে একজন পান্থও পথ দিয়া যাইতেছে না। বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। রাত্রি বাড়িতে লাগিল। বরফ জমিতে লাগিল। বালিকা একাকিনী শৈলপথে পড়িয়া রহিল।
কমলের মাতা ভগ্ন কুটিরে রোগশয্যায় শয়ান। জীর্ণ গৃহ ভেদ করিয়া শীতের বাতাস তীব্রবেগে গৃহে প্রবেশ করিতেছে। বিধবা তৃণশয্যায় শুইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছেন। গৃহ অন্ধকার, প্রদীপ জ্বালিবার লোক নাই। কমল প্রাতে ভিক্ষা করিতে গিয়াছে, এখনও ফিরিয়া আসে নাই। ব্যাকুল বিধবা প্রত্যেক পদশব্দে কমল আসিতেছে বলিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। কমলকে খুঁজিবার জন্য বিধবা কতবার উঠিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু পারেন নাই। কত কী আশঙ্কায় আকুল হইয়া মাতা দেবতার নিকট কাতর ক্রন্দনে প্রার্থনা করিয়াছেন; অশ্রুজলে কতবার কহিয়াছেন, “আমি হতভাগিনী, আমার মরণ হইল না কেন। কখনও ভিক্ষা করিতে জানে না যে বালিকা, তাহাকেও আজ অনাথার মতো দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইতে হইল? ক্ষুদ্র বালিকা অধিক দূর চলিতে পারে না— সে এই অন্ধকারে, তুষারে, বৃষ্টিতে কী করিয়া বাঁচিবে।”
উঠিতে পারেন না— অথচ কমলকে দেখিতে পাইতেছেন না, বিধবা বক্ষে করাঘাত করিয়া অধীর ভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। দুই-একজন প্রতিবাসী বিধবাকে দেখিতে আসিয়াছিল; বিধবা তাহাদের চরণ জড়াইয়া ধরিল সজল নয়নে কাতরভাবে মিনতি করিলেন, “আমার পথহারা কমল কোথায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, একবার তাহাকে খুঁজিতে যাও।”
তাহারা বলিল, “এই তুষারে, অন্ধকারে, আমরা ঘরের বাহিরে যাইতে পারি না।”