মস্ত মস্ত বারকোশ, বড়ো বড়ো পিতলের খোরা, ঝুড়ি ঝুড়ি শাকসব্জি, দশ-পনেরোটা বঁটি পাতা— আত্মীয়া-আশ্রিতারা গল্প করতে করতে দ্রুত হাত চালিয়ে যাচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত খণ্ডবিখণ্ডিত তরকারিগুলো স্তূপাকার হয়ে উঠছে। তারই মধ্যে কুমু এক জায়গায় বসে গেল। সামনে গরাদের ভিতর দিয়ে দেখা যায় পাশের বস্তির এক বৃদ্ধ তেঁতুল গাছ তার চিরচঞ্চল পাতাগুলো দিয়ে সূর্যের আলো চূর্ণ চূর্ণ করে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে।
মোতির মা মাঝে মাঝে কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে আর ভাবে, ও কি কাজ করছে, না, ওর আঙুলের গতি আশ্রয় করে ওর মন চলে যাচ্ছে কোন্ এক তীর্থের পথে? ওকে দেখে মনে হয় যেন পালের নৌকো, আকাশে-তোলা পালটাতে হাওয়া এসে লাগছে, নৌকোটা যেন সেই স্পর্শেই ভোর, আর তার খোলের দু ধারে যে জল কেটে কেটে পড়ছে সেটা যেন খেয়ালের মধ্যেই নেই। ঘরে অন্য যারা কাজ করছে তারা যে কুমুর সঙ্গে গল্পগুজব করবে এমন যেন একটা সহজ রাস্তা পাচ্ছে না। শ্যামাসুন্দরী একবার বললে, “বউ, সকালেই যদি স্নান কর, গরম জল বলে দাও না কেন? ঠাণ্ডা লাগবে না তো?”
কুমু বললে, “আমার অভ্যেস আছে।”
আলাপ আর এগোল না। কুমুর মনের মধ্যে তখন একটা নীরব জপের ধারা চলছে—
প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্।
তরকারি-কোটা ভাঁড়ার-দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে গেল, মেয়েরা স্নানের জন্যে অন্দরের উঠোনে কলতলায় গিয়ে কলরব তুললে।
মোতির মাকে একলা পেয়ে কুমু বললে, “দাদার কাছ থেকে টেলিগ্রাফের জবাব পেয়েছি।”
মোতির মা কিছু আশ্চর্য হয়ে বললে, “কখন পেলে?”
কুমু বললে, “কাল রাত্তিরে।”
“রাত্তিরে!”
“হাঁ, অনেক রাত। তখন উনি নিজে এসে আমার হাতে দিলেন।”
মোতির মা বললে, “তা হলে চিঠিখানাও নিশ্চয় পেয়েছ।”
“কোন্ চিঠি?”
“তোমার দাদার চিঠি।”
ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “না, আমি তো পাই নি! দাদার চিঠি এসেছে নাকি?”
মোতির মা চুপ করে রইল।
কুমু তার হাত চেপে ধরে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললে, “কোথায় দাদার চিঠি, আমাকে এনে দাও-না”।
মোতির মা চুপি চুপি বললে, “সে চিঠি আনতে পারব না, সে বড়োঠাকুরের বাইরের ঘরের দেরাজে আছে।”
“আমার চিঠি কেন আমাকে এনে দিতে পারবে না?”
“তাঁর দেরাজ খুলেছি জানতে পারলে প্রলয়-কাণ্ড হবে।”
কুমু অস্থির হয়ে বললে, “দাদার চিঠি তা হলে আমি পড়তে পাব না?”
“বড়োঠাকুর যখন আপিসে যাবেন তখন সে চিঠি পড়ে আবার দেরাজে রেখে দিয়ো।”
রাগ তো ঠেকিয়ে রাখা যায় না। মনটা গরম হয়ে উঠল। বললে, “নিজের চিঠিও কি চুরি করে পড়তে হবে?”