বাইরের ঘরের সামনের বারান্দায় পৌঁছিয়ে দেখে ঘরে তখনো আলো জ্বলছে। সেও ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময়ে দেখে নবীন লণ্ঠন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। দিনের বেলা হলে দেখতে পেত এক মুহূর্তে নবীনের মুখ কী রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “এত রাত্রে তুমি যে এখানে?”
নবীনের মাথায় বুদ্ধি জোগাল, সে বললে, “শুতে যাবার আগেই তো আমি ঘড়িতে দম দিয়ে যাই, আর তারিখের কার্ড ঠিক করে দিই।”
“আচ্ছা, ঘরে এসে শোনো।”
নবীন ত্রস্ত হয়ে কাঠগড়ার আসামির মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মধুসূদন বললে, “বড়োবউয়ের কানে মন্ত্র ফোসলাবার কেউ থাকে এটা আমি পছন্দ করি নে। আমার ঘরের বউ আমার ইচ্ছেমত চলবে, আর-কারও পরামর্শমত চলবে না— এইটে হল নিয়ম।”
নবীন গম্ভীর ভাবে বললে, “সে তো ঠিক কথা।”
“তাই আমি বলছি, মেজোবউকে দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে।”
নবীন খুব যেন নিশ্চিন্ত হল এমনি ভাবে বললে, “ভালো হল দাদা, আমি আরো ভাবছিলুম পাছে তোমার মত না হয়।”
মধুসূদন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “তার মানে?”
নবীন বললে, “কদিন ধরে দেশে যাবার জন্যে মেজোবউ অস্থির করে তুলেছে, জিনিসপত্র সব গোছানোই আছে, একটা ভালো দিন দেখলেই বেরিয়ে পড়বে।”
বলা বাহুল্য, কথাটা সম্পূর্ণ বানানো। তার বাড়িতে মধুসূদন যাকে ইচ্ছে বিদায় করে দেবে, তাই বলে কেউ নিজের ইচ্ছায় বিদায় হতে চাইবে এটা সম্পূর্ণ বেদস্তুর। বিরক্তির স্বরে বললে, “কেন, যাবার জন্যে তার এত তাড়া কিসের?”
নবীন বললে, “বাড়ির গিন্নি এ বাড়িতে এসেছেন, এখন এ বাড়ির সমস্ত ভার তো তাঁকেই নিতে হবে। মেজোবউ বললে, আমি মাঝে থাকলে কী জানি কখন কী কথা ওঠে।”
মধুসূদন বললে, “এ-সব কথার বিচারভার কি তারই উপরে?”
নবীন ভালোমানুষের মতো বললে, “কী করব বলো, মেয়েমানুষের জেদ। কী জানি, তার মনে হয়েছে, কোন্ কথা নিয়ে তুমি হয়তো একদিন হঠাৎ তাকে সরিয়ে দেবে, সে অপমান তার সইবে না— তাই সে একেবারে পণ করে বসেছে সে যাবেই। আসছে ত্রয়োদশী তিথিতে দিন পড়েছে— এর মধ্যে কাজকর্ম সব গুছিয়ে দিয়ে হিসাবপত্র চুকিয়ে সে চলে যেতে চায়।”
মধুসূদন বললে, “দেখো নবীন, মেজোবউকে আদর দিয়ে তুমিই বিগড়ে দিয়েছ। তাকে একটু কড়া করেই বোলো, সে কিছুতেই যেতে পারবে না। তুমি পুরুষমানুষ, ঘরে তোমার নিজের শাসন চলবে না, এ আমি দেখতে পারি নে।”
নবীন মাথা চুলকিয়ে বললে, “চেষ্টা করে দেখব দাদা, কিন্তু—”
“আচ্ছা, আমার নাম করে বোলো, এখন তার যাওয়া চলবে না। যখন সময় বুঝব তখন যাবার দিন আমিই ঠিক করে দেব।”