দুপুরবেলা আহারের পর দরজা বন্ধ করে কুমু বসে পণ করতে লাগল, মনের মধ্যে কিছুতে সে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠতে দেবে না। কুমু বললে, ‘আজকের দিনটা লাগবে মনকে স্থির করে নিতে; ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে কাল সকাল থেকে সংসারধর্মের সত্যপথে প্রবৃত্ত হব।’ মধ্যাহ্নে আহারের পর তার কাঠের ঘরে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলল নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। এই কাজে সব চেয়ে সহায় ছিল তার দাদার স্মৃতি। সে যে দেখেছে তার দাদার ধৈর্যের আশ্চর্য গভীরতা; তাঁর মুখে সেই বিষাদ, যেটি তাঁর অন্তরের মহত্ত্বের ছায়া— তার সেই দাদা, তখনকার কালে শিক্ষিতসমাজে প্রচলিত পজিটিভিজ্ম্ যাঁর ধর্ম ছিল, দেবতাকে বাইরে থেকে প্রণাম করা যাঁর অভ্যাস ছিল না, অথচ দেবতা আপনিই যাঁর জীবন পূর্ণ করে আবির্ভূত।
অপরাহ্নে বঙ্কু ফরাশ যখন দরজায় আঘাত করলে, ঘর খুলে কুমু বেরিয়ে গেল। মোতির মাকে বললে, আজ রাত্রে সে খাবে না। মনকে বিশুদ্ধ করে নেবার জন্যেই তার এই উপবাস। মোতির মা কুমুর মুখ দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। সে মুখে আজ চিত্তজ্বালার রক্তচ্ছটা ছিল না। ললাটে চক্ষুতে ছিল প্রশান্ত স্নিগ্ধ দীপ্তি। এখনই যেন সে পূজা সেরে তীর্থস্নান করে এল। অন্তর্যামী দেবতা যেন তার সব অভিমান হরণ করে নিলেন; হৃদয়ের মাঝখানে যেন সে এনেছে নির্মাল্যের ফুল বহন করে, তারই সুগন্ধ রয়েছে তাকে ঘিরে। তাই কুমু যখন উপবাসী থাকতে চাইলে তখন মোতির মা বুঝলে, এ অভিমানের আত্মপীড়ন নয়। তাই সে আপত্তিমাত্র করলে না।
কুমু তার ঠাকুরের মূর্তিকে অন্তরের মধ্যে বসিয়ে ছাদের এক কোণে গিয়ে আসন নিল। আজ সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে দুঃখ যদি তাকে এমন করে ধাক্কা না দিত তা হলে সে আপন দেবতার এত কাছে কখনোই আসতে পারত না। অস্তসূর্যের আভার দিকে তাকিয়ে কুমু হাত জোড় করে বললে, “ঠাকুর, আর কখনো যেন তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ না ঘটে; তুমি আমাকে কাঁদিয়ে তোমার আপন করে রাখো।”
শীতের দিন দেখতে দেখতে ম্লান হয়ে এল। ধূলি কুয়াশা ও কলের ধোঁয়াতে মিশ্রিত একটা বিবর্ণ আবরণে সন্ধ্যার স্বচ্ছ তিমির-গম্ভীর মহিমা আচ্ছন্ন। ঐ আকাশটা যেমন একটা পরিব্যাপ্ত মলিনতার বোঝা নিয়ে মাটির দিকে নেমে পড়েছে, তেমনি দাদার জন্যে একটা দুশ্চিন্তার দুঃসহ ভার কুমুর মনটাকে যেন নীচের দিকে নামিয়ে ধরে রেখে দিলে।
এমনি করে এক দিকে কুমু অভিমানের বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মুক্তির আনন্দ, আর-এক দিকে দাদার জন্যে ভাবনায় পীড়িত হৃদয়ের ভার, দুইই একসঙ্গে নিয়ে আবার তার সেই কোটরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। বড়ো ইচ্ছা, এই নিরুপায় ভাবনার বোঝাটাকেও একান্ত বিশ্বাসে ভগবানের উপর সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেয়। কিন্তু নিজেকে বার বার ধিক্কার দিয়েও কিছুতেই সেই নির্ভর পায় না। টেলিগ্রাফ তো করা হয়েছে, তার উত্তর আসে না কেন, এই প্রশ্ন অনবরত মনে লেগেই রইল।
নারীহৃদয়ের আত্মসমর্পণের সূক্ষ্ম বাধায় মধুসূদন কোথাও হাত লাগাতে পারছে না। যে বিবাহিত স্ত্রীর দেহমনের উপর তার সম্পূর্ণ দাবি সেও তার পক্ষে নিরতিশয় দুর্গম। ভাগ্যের এমন অভাবনীয় চক্রান্তকে সে কোন্ দিক থেকে কেমন করে আক্রমণ করবে ভেবে পায় না। কখনো কোনো কারণেই মধুসূদন নিজের ব্যাবসার প্রতি লেশমাত্র অমনোযোগী হয় নি, এখন সেই দুর্লক্ষণও দেখা দিল। নিজের মা’র পীড়া ও মৃত্যুতেও মধুসূদনের কর্মে কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে নি এ কথা সকলেই জানে।
তখন তার অবিচলিত দৃঢ়চিত্ততায় অনেকে তাকে ভক্তি করেছে। মধুসূদন আজ হঠাৎ নিজের একটা নূতন পরিচয় পেয়ে নিজে স্তম্ভিত হয়ে গেছে, বাঁধা-পথের বাইরে যে শক্তি তাকে এমন করে টানছে সে যে তাকে কোন্ দিকে নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছে না।
রাত্রের আহার সেরে মধুসূদন ঘরে শুতে এল। যদিও বিশ্বাস করে নি, তবু আশা করেছিল আজ হয়তো কুমুকে শোবার ঘরে দেখতে পাবে। সেইজন্যেই নিয়মিত সময় অতিক্রম করেই মধুসূদন এল। সুস্থ শরীরে চিরাভ্যাসমত