মেজোবাবু পাংশুবর্ণ মুখে এসে হাজির।
“আমার হুকুম না নিয়ে টেলিগ্রাম পাঠাতে কে বললে?” যে বলেছিল শাসনকর্তার সামনে তার নাম মুখে আনা তো সহজ ব্যাপার নয়; কী বলবে কিছুই ভেবে না পেয়ে নবীন ব্যাকুল হয়ে এই শীতের দিনে ঘেমে উঠল।
নবীনকে নীরব দেখে মধুসূদন আপনিই জিজ্ঞাসা করলে, “মেজোবউ বুঝি?” মুখ হেঁট করে নিরুত্তর থাকাতেই তার উত্তর স্পষ্ট হল। ঝাঁ করে মাথায় রক্ত গেল চড়ে, মুখ হল লাল টকটকে— এত রাগ হল যে, কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরোল না। সবেগে হাত নেড়ে নবীনকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করে ঘরের এক ধার থেকে আর-এক ধার পর্যন্ত পায়চারি করতে লাগল।
নবীন ঘরে গিয়ে মুখ শুকনো করে মোতির মাকে বললে, “মেজোবউ, আর কেন?”
“হয়েছে কী?”
“এবার জিনিসপত্রগুলো বাক্সয় তোলো।”
“তোমার বুদ্ধিতে যদি তুলি, তা হলে আবার কালই বের করতে হবে। কেন? তোমার দাদার মেজাজ ভালো নেই বুঝি?”
“আমি তো চিনি ওঁকে। এবার বোধ হচ্ছে এখানকার বাসায় হাত পড়বে।”
“তা চলোই-না। অত ভাবছ কেন? সেখানে তো জলে পড়বে না?”
“আমাকে চলতে বলছ কিসের জন্যে? এবারে হুকুম হবে মেজোবউকে দেশে পাঠিয়ে দাও।”
“সে হুকুম তুমি মানতে পারবে না জানি।”
“কেমন করে জানলে?”
“আমি কেবল একাই জানি মনে কর, তা নয়— বাড়িসুদ্ধ সবাই তোমাকে স্ত্রৈণ বলে জানে! পুরুষমানুষ যে কী করে স্ত্রৈণ হতে পারে এতদিন তোমার দাদা সে কথা বুঝতেই পারত না। এইবার নিজের বোঝবার পালা এসেছে।”
“বল কী?”
“আমি তো দেখছি তোমাদের বংশে ও রোগটা আছে। এতদিন বড়োভাইয়ের ধাতটা ধরা পড়ে নি। অনেক কাল জমা হয়ে ছিল বলে তার ঝাঁজটা খুব বেশি হবে, দেখে নিয়ো এই আমি বলে দিলাম। যে জোরের সঙ্গে জগৎ-সংসার ভুলে টাকার থলে আঁকড়ে বসেছিল, ঠিক সেই জোরটাই পড়বে বউয়ের উপর।”
“তাই পড়ুক। বড়ো স্ত্রৈণটি আসর জমান কিন্তু মেজো স্ত্রৈণটি বাঁচবে কাকে নিয়ে?”
“সে ভাবনার ভার আমার উপরে। এখন আমি তোমাকে যা বলি তাই করো। ওঁর দেরাজ তোমাকে সন্ধান করতে হবে।”
নবীন হাত জোড় করে বললে, “দোহাই তোমার মেজোবউ— সাপের গর্তে হাত দিতে যদি বলতে আমি দিতুম, কিন্তু দেরাজে না।”
“সাপের গর্তে যদি হাত দিতে হত তবে নিজে দিতুম কিন্তু দেরাজটা সন্ধান তোমাকেই করতে হবে। তুমি তো জান এ বাড়ির সব চিঠিই প্রথমে ওঁকে না দেখিয়ে কাউকে দেবার হুকুম নেই। আমার মন বলছে ওঁর হাতে চিঠি এসেছে।”
“আমারও মন তাই বলছে, কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলছে ও চিঠিতে যদি আমি হাত ঠেকাই তা হলে দাদা উপযুক্ত দণ্ড খুঁজেই পাবে না। বোধ হয় সাত বছর সশ্রম ফাঁসির হুকুম হবে।”