কুমু হাতের মুঠো শক্ত করে একটু হেসে বললে, “না, আমার কিচ্ছু ভয় করছে না।” মনে মনে বলছে, ‘এই আমার অভিসার, বাইরে অন্ধকার ভিতরে আলো।’
ইতিমধ্যে শ্যামাসুন্দরী হাঁপাতে হাঁপাতে মধুকে এসে জানালে, ‘বউ মুর্ছো গেছে।’ মধুসূদনের মনটা দপ করে জ্বলে উঠল; বললে, “কেন, তাঁর হয়েছে কী?”
“তা তো বলতে পারি নে, দাদা দাদা করেই বউ হেদিয়ে গেল। তা একবার কি দেখতে যাবে?”
“কী হবে! আমি তো ওর দাদা নই।”
“মিছে রাগ করছ ঠাকুরপো, ওরা বড়োঘরের মেয়ে, পোষ মানতে সময় লাগবে।”
“রোজ রোজ উনি মুর্ছো যাবেন আর আমি ওঁর মাথায় কবিরাজি তেল মালিশ করব এইজন্যেই কি ওঁকে বিয়ে করেছিলুম?”
“ঠাকুরপো, তোমার কথা শুনে হাসি পায়। তা দোষ হয়েছে কী, আমাদের কালে কথায় কথায় মানিনীর মান ভাঙাতে হত, এখন না হয় মুর্ছো ভাঙাতে হবে।”
মধুসূদন গোঁ হয়ে বসে রইল। শ্যামাসুন্দরী বিগলিত করুণায় কাছে এসে হাত ধরে বললে, “ঠাকুরপো, অমন মন খারাপ কোরো না, দেখে সইতে পারি নে।”
মধুসূদনের এত কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেয় ইতিপূর্বে এমন সাহস শ্যামার ছিল না। প্রগল্ভা শ্যামা ওর কাছে ভারি চুপ করে থাকত; জানত মধুসূদন বেশি কথা সইতে পারে না। মেয়েদের সহজ বুদ্ধি থেকে শ্যামা বুঝেছে মধুসূদন আজ সে-মধুসূদন নেই। আজ ও দুর্বল, নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্কতা ওর নেই। মধুর হাতে হাত দিয়ে বুঝল এটা ওর খারাপ লাগে নি। নববধূ ওর অভিমানে যে ঘা দিয়েছে, কোনো-একটা জায়গা থেকে চিকিৎসা পেয়ে ভিতরে ভিতরে একটু আরাম বোধ হয়েছে। শ্যামা অন্তত ওকে অনাদর করে না, এটা তো নিতান্ত তুচ্ছ কথা নয়। শ্যামা কি কুমুর চেয়ে কম সুন্দরী, না হয় ওর রঙ একটু কালো— কিন্তু ওর চোখ, ওর চুল, ওর রসালো ঠোঁট!
শ্যামা বলে উঠল, “ঐ আসছে বউ, আমি যাই ভাই। কিন্তু দেখো ওর সঙ্গে রাগারাগি কোরো না, আহা ও ছেলেমানুষ!”
কুমু ঘরে ঢুকতেই মধুসূদন আর থাকতে পারলে না, বলে উঠল, “বাপের বাড়ি থেকে মুর্ছো অভ্যেস করে এসেছ বুঝি? কিন্তু আমাদের এখানে ওটা চলতি নেই। তোমাদের ঐ নুরনগরি চাল ছাড়তে হবে।”
কুমু নির্নিমেষ চোখ মেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, একটি কথাও বললে না।
মধুসূদন ওর মৌন দেখে আরো রেগে গেল। মনের গভীর তলায় এই মেয়েটির মন পাবার জন্যে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বলেই ওর এই তীব্র নিষ্ফল রাগ। বলে উঠল, “আমি কাজের লোক, সময় কম, হিস্টিরিয়া-ওয়ালী মেয়ের খেদ্মদগারি করবার