শৈল কহিল, “ছি মুখুজ্যেমশায়, তুমি সেকেলে হয়ে যাচ্ছ। ঐ-সব নয়ন-বাণ-টানগুলোর এখন কি আর চলন আছে? যুদ্ধবিদ্যার যে এখন অনেক বদল হয়ে গেছে।”
ইতিমধ্যে দুই বোন নৃপবালা, নীরবালা– ষোড়শী এবং চতুর্দশী প্রবেশ করিল। নৃপ শান্ত স্নিগ্ধ, নীরু তাহার বিপরীত, কৌতুকে এবং চাঞ্চল্যে সে সর্বদাই আন্দোলিত।
নীরু আসিয়াই শৈলকে জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মেজদিদি ভাই, আজ কারা আসবে বলো তো?”
নৃপবালা। মুখুজ্যেমশায়, আজ কি তোমার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ আছে? জলখাবারের আয়োজন হচ্ছে কেন?
অক্ষয়। ঐ তো! বই পড়ে পড়ে চোখ কানা করলে– পৃথিবীর আকর্ষণে উল্কাপাত কী করে ঘটে সে-সমস্ত লাখ দু-লাখ ক্রোশের খবর রাখ, আর আজ ১৮ নম্বর মধুমিস্ত্রির গলিতে কার আকর্ষণে কে এসে পড়ছে সেটা অনুমান করতেও পারলে না!
নীরবালা। বুঝেছি ভাই সেজদিদি!– বলিয়া নৃপর পিঠে একটা চাপড় মারিল এবং তাহার কানের কাছে মুখ রাখিয়া অল্প একটু গলা নামাইয়া কহিল, “তোর বর আসছে ভাই, তাই সকালবেলা আমার বাঁ চোখ নাচছিল।”
নৃপ তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “তোর বাঁ চোখ নাচলে আমার বর আসবে কেন?”
নীরু কহিল, “তা ভাই, আমার বাঁ চোখটা নাহয় তোর বরের জন্যে নেচে নিলে তাতে আমি দুঃখিত নই। কিন্তু মুখুজ্যেমশায়, জলখাবার তো দুটি লোকের জন্যে দেখলুম, সেজদিদি কি স্বয়ম্বরা হবে না কি?”
অক্ষয়। আমাদের ছোড়দিদিও বঞ্চিত হবেন না।
নীরবালা। আহা মুখুজ্যেমশায়, কী সুসংবাদ শোনালে! তোমাকে কী বকশিশ দেব। এই নাও আমার গলার হার, আমার দু-হাতের বালা।
শৈল ব্যস্ত হইয়া বলিল, “আঃ ছিঃ, হাত খালি করিস নে।”
নীরবালা। আজ আমাদের বরের অনারে পড়ার ছুটি দিতে হবে মুখুজ্যেমশায়।
নৃপবালা। আঃ কী বর-বর করছিস। দেখো তো ভাই মেজদিদি!
অক্ষয়। ওকে ঐজন্যেই তো বর্বরা নাম দিয়েছি। অয়ি বর্বরে, ভগবান তোমাদের কটি সহোদরাকে এই একটি অক্ষয় বর দিয়ে রেখেছেন তবু তৃপ্তি নেই?
নীরবালা। সেইজন্যেই তো লোভ আরো বেড়ে গেছে।
নৃপ তাহার ছোটো বোনকে সংযত করা অসাধ্য দেখিয়া তাহাকে টানিয়া লইয়া চলিল। নীরু চলিতে চলিতে দ্বারের নিকট হইতে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “এলে খবর দিয়ো মুখুজ্যেমশায়, ফাঁকি দিয়ো না। দেখছ তো সেজদিদি কিরকম চঞ্চল হয়ে উঠেছে।”
সহাস্য সস্নেহে দুই বোনকে নিরীক্ষণ করিয়া শৈল কহিল, “মুখুজ্যেমশায়, আমি ঠাট্টা করছি নে– আমি চিরকুমার– সভার সভ্য হব। কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচিত একজন কাউকে চাই তো। তোমার বুঝি আর সভ্য হবার জো নেই?”
অক্ষয়। না, আমি পাপ করেছি। তোমার দিদি আমার তপস্যা ভঙ্গ করে আমাকে স্বর্গ হতে বঞ্চিত করেছেন।
শৈল। তা হলে রসিকদাদাকে ধরতে হচ্ছে। তিনি তো কোনো সভার সভ্য না হয়েও চিরকুমার ব্রত রক্ষা করেছেন।
অক্ষয়। সভ্য হলেই এই বুড়োবয়সে ব্রতটি খোওয়াবেন। ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়– প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই তার সর্বনাশ।
এমন সময়, সম্মুখের মাথায় টাক, পাকা গোঁফ, গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, রসিকদাদা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অক্ষয় তাঁহাকে