শুনিয়া অম্বিকাচরণ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। অবশেষে কহিলেন, “আজ কিছুই ভেবে উঠতে পারছি নে, কাল এর পরামর্শ করা যাবে। ”
খাজাঞ্চি যখন বিদায় লইতে উঠিলেন তখন অম্বিকা তাঁহার ইস্তাফপত্র চাহিয়া লইলেন।
অন্তঃপুরে আসিয়া অম্বিকা ইন্দ্রাণীকে সকল কথা বিস্তারিত জানাইয়া কহিলেন, “বিনোদের এ অবস্থায় তো আমি কাজ ছেড়ে দিতে পারি নে।”
ইন্দ্রাণী অনেকক্ষণ প্রস্তরমূর্তির মতো স্থির হইয়া রহিল। অবশেষে অন্তরের সমস্ত বিরোধদ্বন্দ্ব সবলে দলন করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “না এখন ছাড়তে পার না।”
তাহার পরে ‘কোথায় টাকা’ ‘কোথায় টাকা’ করিয়া সন্ধান পড়িয়া গেল— যথেষ্ট পরিমাণে টাকা আর জুটে না। অন্তঃপুর হইতে গহনাগুলি সংগ্রহ করিবার জন্য অম্বিকা বিনোদকে পরামর্শ দিলেন। ইতিপূর্বে ব্যবসা উপলক্ষে বিনোদ সে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কখনো কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এবারে অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া, অনেক কাঁদিয়া-কাটিয়া, অনেক দীনতা স্বীকার করিয়া গহনাগুলি ভিক্ষা চাহিলেন। নয়নতারা কিছুতেই দিলেন না; তিনি মনে করিলেন, তাঁহার চারি দিক হইতে সকলই খসিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে; এখন এই গহনাগুলি তাঁহার একমাত্র শেষ অবলম্বনস্থল— এবং ইহা তিনি অন্তিম আগ্রহ সহকারে প্রাণপণে চাপিয়া ধরিলেন।
যখন কোথা হইতেও কোনো টাকা পাওয়া গেল না তখন ইন্দ্রাণীর প্রতিহিংসাভ্রূকুটির উপরে একটা তীব্র আনন্দের জ্যোতি পতিত হইল। সে তাহার স্বামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তোমার যাহা কর্তব্য তাহা তো করিয়াছ; এখন তুমি ক্ষান্ত হও, যাহা হইবার তা হউক।”
স্বামীর অবমাননায় উদ্দীপ্ত সতীর রোষানল এখনো নির্বাপিত হয় নাই দেখিয়া অম্বিকা মনে মনে হাসিলেন। বিপদের দিনে অসহায় বালকের ন্যায় বিনোদ তাঁহার উপরে এমন একান্ত নির্ভর করিয়াছে যে, তাহার প্রতি তাঁহার দয়ার উদ্রেক হইয়াছে— এখন তাহাকে তিনি কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারেন না। তিনি মনে করিতেছিলেন, তাঁহার নিজের বিষয় আবদ্ধ রাখিয়া টাকা উঠাইবার চেষ্টা করিবেন। কিন্তু ইন্দ্রাণী তাঁহাকে মাথার দিব্য দিয়া বলিল, “ইহাতে আর তুমি হাত দিতে পারিবে না।”
অম্বিকাচরণ বড়ো ইতস্ততের মধ্যে পড়িয়া ভাবিতে বসিয়া গেলেন। তিনি ইন্দ্রাণীকে আস্তে আস্তে বুঝাইবার যতই চেষ্টা করিতে লাগিলেন ইন্দ্রাণী কিছুতেই তাঁহাকে কথা কহিতে দিল না। অবশেষে অম্বিকা কিছু বিমর্ষ হইয়া, গম্ভীর হইয়া, নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন।
তখন ইন্দ্রাণী লোহার সিন্দুক খুলিয়া তাহার সমস্ত গহনা একটি বৃহৎ থালায় স্তুপাকার করিল এবং সেই গুরুভার থালাটি বহুকষ্টে দুই হস্তে তুলিয়া ঈষৎ হাসিয়া তাহার স্বামীর পায়ের কাছে রাখিল।
পিতামহের একমাত্র স্নেহের ধন ইন্দ্রাণী পিতামহের নিকট হইতে জন্মাবধি বৎসরে বৎসরে অনেক বহুমূল্য অলংকার উপহার পাইয়া আসিয়াছে; মিতাচারী স্বামীরও জীবনের অধিকাংশ সঞ্চয় এই সন্তানহীন রমণীর ভাণ্ডারে অলংকাররূপে রূপান্তরিত হইয়াছে।