সে রাত্রে বিপ্রদাস বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। জানে না, কুমুদিনীর চোখেও ঘুম নেই। এক সময়ে যখন বড়ো অসহ্য হল কুমু ছুটে এসে বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “সত্যি করে বলো দাদা, ছোড়দাদার কী হয়েছে? পায়ে পড়ি, আমার কাছে লুকিয়ো না।”
বিপ্রদাস বুঝলে গোপন করতে গেলে কুমুদিনীর আশঙ্কা আরো বেড়ে উঠবে। একটু চুপ করে থেকে বললে, “সুবোধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, অত টাকা দেবার শক্তি আমার নেই।”
কুমু বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “দাদা, একটা কথা বলি, রাগ করবে না বলো।”
“রাগ করবার মতো কথা হলে রাগ না করে বাঁচব কী করে?”
“না দাদা, ঠাট্টা নয়, শোনো আমার কথা— মায়ের গয়না তো আমার জন্যে আছে, তাই নিয়ে—”
“চুপ, চুপ, তোর গয়নায় কি আমরা হাত দিতে পারি!”
“আমি তো পারি।”
“না, তুইও পারিস নে। থাক্ সে-সব কথা, এখন ঘুমোতে যা।”
কলকাতা শহরের সকাল, কাকের ডাক ও স্ক্যাভেঞ্জারের গাড়ির খড়খড়ানিতে রাত পোয়ালো। দূরে কখনো স্টীমারের, কখনো তেলের কলের বাঁশি বাজে। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে একজন লোক মই কাঁধে জ্বরারি-বটিকার বিজ্ঞাপন খাটিয়ে চলেছে; খালি-গাড়ির দুটো গোরু গাড়োয়ানের দুই হাতের প্রবল তাড়ার উত্তেজনায় গাড়ি নিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান; কল থেকে জল নেবার প্রতিযোগিতায় এক হিন্দুস্থানি মেয়ের সঙ্গে উড়িয়া ব্রাক্ষ্মণের ঠেলাঠেলি বকাবকি জমেছে। বিপ্রদাস বারান্দায় বসে; গুড়গুড়ির নলটা হাতে; মেজেতে পড়ে আছে না-পড়া খবরের কাগজ।
কুমু এস বললে, “দাদা, ‘না’ বোলো না।”
“আমার মতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবি তুই? তোর শাসনে রাতকে দিন, ‘না’-কে হাঁ করতে হবে।”
“না, শোনো বলি— আমার গয়না নিয়ে তোমার ভাবনা ঘুচুক।”
“সাধে তোকে বলি বুড়ি? তোর গয়না নিয়ে আমার ভাবনা ঘুচবে এমন কথা ভাবতে পারলি কোন্ বুদ্ধিতে?”
“সে জানি নে, কিন্তু তোমার এই ভাবনা আমার সয় না।”
“ভেবেই ভাবনা শেষ করতে হয় রে, তাকে ফাঁকি দিয়ে থামাতে গেলে বিপরীত ঘটে। একটু ধৈর্য ধর্, একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
বিপ্রদাস সে মেলে চিঠিতে লিখলে, টাকা পাঠাতে হলে কুমুর পণের সম্বলে হাত দিতে হয়; সে অসম্ভব।
যথাসময়ে উত্তর এল। সুবোধ লিখেছে কুমুর পণের টাকা সে চায় না। সম্পত্তিতে তার নিজের অর্ধ অংশ বিক্রি করে যেন টাকা পাঠানো হয়। সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি পাঠিয়েছে।
এ চিঠি বিপ্রদাসের বুকে বাণের মতো বিঁধল। এতবড়ো নিষ্ঠুর চিঠি সুবোধ লিখল কী করে! তখনই বুড়ো দেওয়ানজিকে ডেকে পাঠালে। জিজ্ঞাসা করলে, “ভূষণ রায়রা করিমহাটি তালুক পত্তনি নিতে চেয়েছিল না? কত পণ দেবে?”
দেওয়ান বললে, “বিশ হাজার পর্যন্ত উঠতে পারে।”
“ভূষণ রায়কে তলব দিয়ে পাঠাও। কথাবার্তা কইতে চাই।”
বিপ্রদাস বংশের বড়ো ছেলে। তার জন্মকালে তার পিতামহ এই তালুক স্বতন্ত্র ভাবে তাকেই দান করেছেন। ভূষণ রায় মস্ত মহাজন, বিশ-পঁচিশ লাখ টাকার তেজারতি। জন্মস্থান করিমহাটিতে। এইজন্যে অনেক দিন থেকে নিজের গ্রাম পত্তনি নেবার চেষ্টা।