এই-সকল কথা মনে করিয়া ইন্দ্রাণী কোনো সান্ত্বনা পাইল না, বরং অপমান আরো বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল। মহাভারতে বণির্ত শুক্রাচার্যদুহিতা দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার কথা মনে পড়িল। দেবযানী যেমন তাহার প্রভুকন্যা শর্মিষ্ঠার দর্প চূর্ণ করিয়া তাহাকে দাসী করিয়াছিল, ইন্দ্রাণী যদি তেমনি করিতে পারিত তবেই যথোপযুক্ত বিধান হইত। এক সময় ছিল, যখন দৈত্যদের নিকট দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের ন্যায় মুকুন্দবাবুর পরিবারবর্গের নিকট তাহার পিতামহ গৌরীকান্ত একান্ত আবশ্যক ছিলেন। তখন তিনি যদি ইচ্ছা করিতেন তবে মুকুন্দবাবুকে হীনতা স্বীকার করাইতে পারিতেন। কিন্তু তিনিই মুকুন্দলালের বিষয়সম্পত্তিকে উন্নতির চরম সীমায় উত্তীর্ণ করিয়া দিয়া সর্বপ্রকার শৃঙ্খলা স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, অতএব আজ আর তাঁহাকে স্মরণ করিয়া প্রভুদের কৃতজ্ঞ হইবার আবশ্যকতা নাই। ইন্দ্রাণী মনে করিল, বাঁকাগাড়ি পরগনা তাহার পিতামহ অনায়াসে নিজের জন্যই কিনিতে পারিতেন, তখন তাঁহার সে ক্ষমতা জন্মিয়াছিল, তাহা না করিয়া তিনি সেটা মনিবকে কিনিয়া দিলেন— ইহা যে একপ্রকার দান করা সে কথা কি আজ সেই মনিবের বংশে কেহ মনে করিয়া রাখিয়াছে। ‘আমাদেরই দত্ত ধনমানের গর্বে তোমরা আমাদিগকে আজ অপমান করিবার অধিকার পাইয়াছ’ ইহাই মনে করিয়া ইন্দ্রাণীর চিত্ত ক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিল।
বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল তাহার স্বামী প্রভুগৃহের নিমন্ত্রণ ও তাহার পরে জমিদারি কাছারির সমস্ত কাজকর্ম সারিয়া তাঁহার শয়নকক্ষের একটি কেদারা আশ্রয় করিয়া নিভৃতে খবরের কাগজ পাঠ করিতেছেন।
অনেকের ধারণা আছে যে, স্বামী-স্ত্রীর স্বভাব প্রায়ই একরূপ হইয়া থাকে। তাহার কারণ, দৈবাৎ কোনো কোনো স্থলে স্বামী-স্ত্রীর স্বভাবের মিল দেখিতে পাইলে সেটা আমাদের নিকট এমন সমুচিত এবং সংগত বলিয়া বোধ হয় যে, আমরা আশা করি এই নিয়ম বুঝি অধিকাংশ স্থলেই খাটে। যাহা হউক, বর্তমান ক্ষেত্রে অম্বিকাচরণের সহিত ইন্দ্রাণীর দুই-একটা বিশেষ বিষয়ে বাস্তবিক স্বভাবের মিল দেখা যায়। অম্বিকাচরণ তেমন মিশুক লোক নহেন। তিনি বাহিরে যান কেবলমাত্র কাজ করিতে। নিজের কাজ সম্পূর্ণ শেষ করিয়া এবং অন্যকে পুরামাত্রায় কাজ করাইয়া লইয়া বাড়ি আসিয়া যেন তিনি অনাত্মীয়তার আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য এক দুর্গম দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করেন। বাহিরে তিনি এবং তাঁহার কর্তব্য কর্ম, ঘরের মধ্যে তিনি এবং তাঁহার ইন্দ্রাণী, ইহাতেই তাঁহার সমস্ত জীবন পর্যাপ্ত।
ভূষণের ছটা বিস্তার করিয়া যখন সুসজ্জিতা ইন্দ্রাণী ঘরে প্রবেশ করিলেন তখন অম্বিকাচরণ তাঁহাকে পরিহাস করিয়া কী একটা কথা বলিবার উপক্রম করিলেন, কিন্তু সহসা ক্ষান্ত হইয়া চিন্তিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কী হয়েছে।”
ইন্দ্রাণী তাঁহার সমস্ত চিন্তা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “কী আর হবে। সম্প্রতি আমার স্বামিরত্নের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে।”
অম্বিকা খবরের কাগজ ভূমিতলে ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, “সে তো আমার অগোচর নেই। তৎপূর্বে? ”
ইন্দ্রাণী একে একে গহনা খুলিতে খুলিতে বলিলেন, “তৎপূর্বে স্বামিনীর কাছ থেকে সমাদর লাভ হয়েছে।”
অম্বিকা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সমাদরটা কী রকমের।”
ইন্দ্রাণী স্বামীর কাছে আসিয়া তাঁহার কেদারার হাতার উপর বসিয়া তাঁহার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া উত্তর করিল, “তোমার কাছ থেকে যে রকমের পাই ঠিক সেই রকমের নয়।”
তাহার পর, ইন্দ্রাণী একে একে সকল কথা বলিয়া গেল। সে মনে করিয়াছিল স্বামীর কাছে এ-সকল অপ্রিয় কথার উত্থাপন