Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


প্রগতিসংহার, ৮
প্রগতিসংহার

প্রত্যেকবারেই সুরীতি ভালো কিছু দেখবার থাকলে সিনেমাতে যেত। এখন তার কী হল! এত বড়ো আত্মত্যাগ তো কল্পনা করা যায় না, এমন-কি আজকালকার দিনে যে সামাজিক নিমন্ত্রণে স্ত্রীপুরুষের এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলত, সেখানে সে যাওয়া ছেড়ে দিলে। সনাতনীরা খুব তার প্রশংসা করতে লাগল। প্রগতিসংঘ থেকে সে নিজেই আপনার নাম কাটিয়ে নিলে।

সুরীতি চাকরি নেবে, নীহারের অনুমতি চাইল—স্কুলে পুরুষ ছাত্র খুব ছোটো বয়সের হলেও তাদের পড়ানো চলে কি না।

নীহার বললে, না, তাও চলে না। তার ফল হল সে অর্ধেক মাইনে স্বীকার করে মাস্টারি নিয়ে বললে, তার বাকি বেতন থেকে ছেলেদের আলাদা পড়াবার লোক রাখা হোক। স্কুলের সেক্রেটারিবাবু অবাক।

সুরীতির মনের টান ক্রমশ দুঃসহ হয়ে উঠতে লাগল। এক সময়ে কোনোরকম করে আভাস দিয়েছিল, তাদের বিয়ে হতে পারে কি না। একদিন যে সমাজের নিয়মকে সুরীতি মানত না, সেই সমাজের নিয়ম অনুসারে শুনতে পেল ওদের বিয়ে হতে পারে না কোনোমতেই। অথচ এই পুরুষের আনুগত্য রক্ষা করে চিরকাল মাথা নিচু করে চলতে পারে তাতে অপরাধ নেই, কেননা বিধাতার সেই বিধান।

প্রায়ই সে শুনতে পায়—নীহারের অবস্থা ভালো নয়, পড়বার বই তাকে ধার করে পড়তে হয়। তখন সুরীতি নিজের জলপানি থেকে ওকে যথেষ্ট সাহায্য করতে লাগল। নীহারের তাতে কোনো লজ্জা ছিল না। মেয়েদের কাছ থেকে পুরুষদের যেন অর্ঘ্য নেবার অধিকার আছে। অথচ তার বিদ্যার অভিমানের অন্ত ছিল না। একবার একটি কলেজে বাংলা অধ্যাপকের পদ খালি ছিল। সুরীতির অনুরোধে নীহারকে সে পদে গ্রহণ করবার প্রস্তাবে অনুকূল আলোচনা চলছিল। তাতে নীহারের নাম নিয়ে কমিটিতে এই আলোচনায় তার অহংকারে ঘা লাগল।

সুরীতি নীহারকে বললে, “এ তোমার অন্যায় অভিমান। স্বয়ং ভাইসরয় নিযুক্ত করবার সময়েও কাউন্সিলের মেম্বারদের মধ্যে তা নিয়ে কথাবার্তা চলে।”

নীহার বললে, “তা হতে পারে, কিন্তু আমাকে যেখানে গ্রহণ করবে সেখানে বিনা তর্কেই গ্রহণ করবে। এ না হলে আমার মান বাঁচবে না। আমি বাংলা ভাষায় এম. এ তে সর্ব-প্রথম পদবী পেয়েছি। আমি অমন করে কমিটি থেকে ঝাঁট দিয়ে নেওয়া পদ নিতে পারব না।”

এ পদ যদি নিত তা হলে সুরীতির কাছ থেকে অর্থসাহায্যের প্রয়োজন চলে যেত নীহারের। পদকে সে অগ্রাহ্য করলে, কিন্তু এই প্রয়োজনকে না। সুরীতির জলখাবার প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ির লোকে ওর ব্যবহারে এবং চেহারায় অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হয়ে উঠল।

ছেলেবেলা থেকেই ওর শরীর ভালো নয়, তার উপরে এই কষ্ট করা—এ তপস্যা কার জন্য সে কথা যখন তারা ধরতে পারলে তখন তারা নীহারকে গিয়ে বললে, “হয় তুমি একে বিবাহ করো, নয় এর সঙ্গ ত্যাগ করো।”

নীহার বললে, “বিবাহ করা তো চলবেই না—আর ত্যাগের কথা আমাকে বলছেন কেন, সঙ্গ ইচ্ছে করলেই তো তিনি ত্যাগ করতে পারেন, আমার তাতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই।”

সুরীতি সে কথা জানত। সে জানত নীহারের কাছে তার কোনো মূল্যই নেই, নিজের সুবিধাটুকু ছাড়া। সেই সুবিধাটুকু বন্ধ হলে তাকে অনায়াসে পথের কুকুরের মতো খেদিয়ে দিতে পারে। এ জেনেও যত রকমে পারে সুবিধে দিয়ে, বই কিনে দিয়ে, নতুন খদ্দরের থান তাকে উপহার দিয়ে, যেমন করে পারে তাকে এই সুবিধার স্বার্থবন্ধনে বেঁধে রাখলে। অন্য গতি ছিল না ব’লে এই অসম্মান সুরীতি স্বীকার করে নিলে।

এক সময়ে মফস্বলে বেশি মাইনের প্রিন্সিপালের পদ পেয়েছিল। তখন তার কেবল এই মনের ভিতরে বাজত, ‘আমি তো খুব আরামে আছি, কিন্তু তিনি তো ওখানে গরিবের মতো পড়ে থাকেন—এ আমি সহ্য করব কী করে’। অবশেষে একদিন বিনা কারণে