Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


শেষের কবিতা -৭, ২৯
শেষের কবিতা

“চমৎকার! পদাবলীতে ওরই একটি দোসর আছে– বঁধু। বন্যা, মনে ভাবছি, ঐ নামে নাহয় আমাকে সবার সামনেই ডাকলে, তাতে দোষ কী।?”

“ভয় হয়, এক কানের ধন পাঁচ কানে পাছে সস্তা হয়ে যায়।”

“সে কথা মিছে নয়। দুইয়ের কানে যেটা এক, পাঁচের কানে সেটা ভগ্নাংশ। বন্যা।”

“কী মিতা।”

“তোমার নামে যদি কবিতা লিখি তো কোন্‌ মিলটা লাগাব জান? –অনন্যা!”

“তাতে কী বোঝাবে।”

“বোঝাবে, তুমি যা তুমি তাই-ই, তুমি আর কিছুই নও।”

“সেটা বিশেষ আশ্চর্যের কথা নয়।”

“বল কী, খুবই আশ্চর্যের কথা। দৈবাৎ এক-একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় যাকে দেখেই চমকে বলে উঠি, এ মানুষটি একেবারে নিজের মতো, পাঁচজনের মতো নয়। সেই কথাটি আমি কবিতায় বলব–

                     হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা,

                     আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা।”

“তুমি কবিতা লিখবে নাকি?”

“নিশ্চয়ই লিখব। কার সাধ্য রোধে তার গতি।”

“এমন মরিয়া হয়ে উঠলে কেন।”

“কারণ বলি। কাল রাত্তির আড়াইটা পর্যন্ত, ঘুম না হলে যেমন এ-পাশ ও-পাশ করতে হয় তেমনি করেই, কেবলই অক্স্‌‍ফোর্ড্ বুক অফ ভর্সেস-এর এ-পাত ও-পাত উলটেছি। ভালোবাসার কবিতা খুঁজেই পেলুম না, আগে সেগুলো পায়ে পায়ে ঠেকত। স্পষ্টই বুঝতে পারছি, আমি লিখব বলেই সমস্ত পৃথিবী আজ অপেক্ষা করে আছে।”

‍

এই বলেই লাবণ্যর বাঁ হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে চেপে ধরে বললে, “হাত জোড়া পড়ল, কলম ধরব কী দিয়ে। সব চেয়ে ভালো মিল হাতে হাতে মিল। এই-যে তোমার আঙুলগুলি আমার আঙুলে আঙুলে কথা কইছে, কোনো কবিই এমন সহজ করে কিছু লিখতে পারলে না।”

“কিছুই তোমার সহজে পছন্দ হয় না, সেইজন্যে তোমাকে এত ভয় করি মিতা।”

“কিন্তু আমার কথাটা বুঝে দেখো। রামচন্দ্র সীতার সত্য যাচাই করতে চেয়েছিলেন বাইরের আগুনে; তাতেই সীতাকে হারালেন। কবিতার সত্য যাচাই হয় অগ্নিপরীক্ষায়, সে আগুন অন্তরের। যার মনে নেই সেই আগুন সে যাচাই করবে কী দিয়ে। তাকে পাঁচজনের মুখের কথা মেনে নিতে হয়, অনেক সময়ই সেটা দুর্মুখের কথা। আমার মনে আজ আগুন জ্বলেছে, সেই আগুনের ভিতর দিয়ে আমার পুরোনো সব পড়া আবার পড়ে নিচ্ছি, কত অল্পই টিঁকল। সব হু হু শব্দে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কবিদের হট্টগোলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজ আমাকে বলতে হল, তোমরা অত চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না, ঠিক কথাটি আস্তে বলো–

               “For God’s sake, hold your tongue

                     and let me love!”

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইল। তার পরে এক সময়ে লাবণ্যর হাতখানি তুলে ধরে অমিত নিজের মুখের উপর বুলিয়ে