জিজ্ঞাসা করলুম, “কেন।”
অনিলা বললেন, “সরোজের পরীক্ষার ফল শীঘ্র বেরোবে— তার জন্য মনটা উদ্বিগ্ন আছে, এ কয়দিন আর নড়াচড়া করতে ভালো লাগছে না।”
অন্যান্য অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে এই একটি বিষয় আছে যা নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি কখনো আলোচনা করি নে। সুতরাং আপাতত কিছুদিন বাড়িবদল মুলতবি রইল। ইতিমধ্যে খবর পেলুম, সিতাংশু শীঘ্রই দক্ষিণভারতে বেড়াতে বেরোবে, সুতরাং দুই-নম্বরের উপর থেকে মস্ত ছায়াটা সরে যাবে।
অদৃষ্ট নাট্যের পঞ্চমাঙ্কের শেষ দিকটা হঠাৎ দৃষ্ট হয়ে ওঠে। কাল আমার স্ত্রী তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন; আজ ফিরে এসে তাঁর ঘরে দরজা বন্ধ করলেন। তিনি জানেন, আজ রাত্রে আমাদের দ্বৈতদলের পূর্ণিমার ভোজ। তাই নিয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করবার অভিপ্রায়ে দরজায় ঘা দিলুম। প্রথমে সাড়া পাওয়া গেল না। ডাক দিলুম “অনু!” খানিক বাদে অনিলা এসে দরজা খুলে দিলে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “আজ রাত্রে রান্নার জোগাড় সব ঠিক আছে তো? ”
সে কোনো জবাব না দিয়ে মাথা হেলিয়ে জানালে যে, আছে।
আমি বললুম, “তোমার হাতের তৈরি মাছের কচুরি আর বিলাতি আমড়ার চাট্নি ওদের খুব ভালো লাগে, সেটা ভুলো না।”
এই বলে বাইরে এসেই দেখি কানাইলাল বসে আছে।
আমি বললুম, “কানাই, আজ তোমরা একটু সকাল-সকাল এসো।”
কানাই আশ্চর্য হয়ে বললে, “সে কী কথা। আজ আমাদের সভা হবে না কি।”
আমি বললুম, “হবে বৈকি। সমস্ত তৈরি আছে— ম্যাক্সিম গর্কির নতুন গল্পের বই, বের্গসঁর উপর রাসেলের সমালোচনা, মাছের কচুরি, এমন-কি, আমড়ার চাট্নি পর্যন্ত।”
কানাই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক বাদে বললে, “অদ্বৈতবাবু, আমি বলি, আজ থাক্।”
অবশেষে প্রশ্ন করে জানতে পারলুম, আমার শ্যালক সরোজ কাল বিকেলবেলায় আত্মহত্যা করে মরেছে। পরীক্ষায় সে পাস হতে পারে নি, তাই নিয়ে বিমাতার কাছ থেকে খুব গঞ্জনা পেয়েছিল— সইতে না পেরে গলায় চাদর বেঁধে মরেছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “তুমি কোথা থেকে শুনলে? ”
সে বললে, “পয়লা-নম্বর থেকে।”
পয়লা-নম্বর থেকে! বিবরণটা এই— সন্ধ্যার দিকে অনিলার কাছে যখন খবর এল তখন সে গাড়ি ডাকার অপেক্ষা না ক’রে অযোধ্যাকে সঙ্গে নিয়ে পথের মধ্যে থেকে গাড়ি ভাড়া করে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল। অযোধ্যার কাছ থেকে রাত্রে সিতাংশুমৌলী এই খবর পেয়েই তখনি সেখানে গিয়ে পুলিশকে ঠাণ্ডা করে নিজে শ্মশানে উপস্থিত থেকে মৃতদেহের সৎকার করিয়ে দেন।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে তখনি অন্তঃপুরে গেলুম। মনে করেছিলুম, অনিলা বুঝি দরজা বন্ধ করে আবার তার শোবার ঘরের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু, এবারে গিয়ে দেখি, ভাঁড়ারের সামনের বারান্দায় বসে সে আমড়ার চাট্নির আয়োজন করছে। যখন লক্ষ্য করে তার মুখ দেখলুম তখন বুঝলুম, এক রাত্রে তার জীবনটা উলট-পালট হয়ে গেছে। আমি অভিযোগ করে বললুম, “আমাকে কিছু বলনি কেন।”
সে তার বড়ো বড়ো দুই চোখ তুলে একবার আমার মুখের দিকে তাকালে— কোনো কথা কইলে না। আমি লজ্জায় অত্যন্ত ছোটো হয়ে গেলুম। যদি অনিলা বলত ‘তোমাকে ব’লে লাভ কী’, তা হলে আমার জবাব দেবার কিছুই থাকত না। জীবনের এই-সব বিপ্লব— সংসারের সুখ দুঃখ— নিয়ে কী করে যে ব্যবহার করতে হয়, আমি কি তার কিছুই জানি।