এই যুগের যে আহ্বান আমাদের নিকট আসিয়াছে, আমরা যেন তাহার যোগ্য হই এবং মাহাত্মাজীর নিকট হইতে আমরা সেই দায়িত্ব যেন গ্রহণ করি, যে দায়িত্ব তিনি নিজের জন্য গ্রহণ করিয়াছেন। আমরা জানি যে, সর্বমানবের হৃদয়ে সর্বদা বিরাজমান উপনিষদের দেবতাকে ‘মহাত্মা’ বলা হইয়াছে। আমরা আজ যে দেবমানবের সংবর্ধনা করিতেছি, তাঁহাকে ওই আখ্যাটি ঠিকই দেওয়া হইয়াছে— কারণ তাঁহার মহান আত্মা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে। যাহারা ভারতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এবং যাহারা পরে জন্মগ্রহণ করিবে সেই অগণিত জনগণের হৃদয়ে তিনি বিরাজ করিতেছেন। তাঁহার আত্মার এই মহত্ত্ব— অন্য সকলকে নিজের হৃদয়ে ধারণ করিবার এই ক্ষমতা আমাদের ইতিহাসে যাহা কখনো ঘটে নাই, তাহাই সম্ভব করিয়াছে, আজ জনসাধারণ পর্যন্ত এ কথা বুঝিতে পারিয়াছে যে, ভারতবর্ষ শুধু ভৌগলিক অস্তিত্ব মাত্র নহে— ভারতবর্ষ একটি জীবন্ত সত্য, যে সত্যের মধ্যে তাহারা সর্বদা বাঁচিয়া আছে এবং সঞ্চরণ করিতেছে।
দৈবায়ত্ত জন্মসূত্রে যাহারা ঘৃণ্য বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে, যাহাদের ন্যুব্জ পৃষ্ঠে শুধু অশ্রদ্ধারই বোঝা চাপানো হইয়াছে, যে সহানুভূতি সমস্ত মানুষের জন্মগত অধিকার, সেই সহানুভূতি হইতে আমাদের দেশের যে বৃহৎ জনসংখ্যাকে ইচ্ছাপূর্বক বঞ্চিত রাখা হইয়াছে, তাহাদের প্রতি এই অনাচার বহু যুগ সঞ্চিত এই গুরুভার বোঝা, এই সহানুভূতি-বঞ্চনার পাপ দূর করিবার জন্য মহাত্মাজী সংকল্প করিয়াছেন। তাঁহার এই মহৎ কার্যে যোগ দিবার জন্য আমাদের দৃড় চেষ্টা আমরা শুধু ভারতের নৈতিক দাসত্বের নিগড়কেই খসাইয়া ফেলিতেছি না— আমরা সমস্ত মনুষ্য জাতিকে পথপ্রদর্শন করিতেছি। অত্যাচার যেখানে, যে ভাবেই থাকুক-না-কেন, আমরা তাহাকে বিবেকের নিকট জবাব দিবার জন্য আহ্ববান করিতেছি। বিবেকের এই নিষ্করুণ প্রশ্ন-জিজ্ঞাসাকেই মহাত্মাজী আমাদের যুগের সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। মহাত্মাজী যখন অনশনব্রত আরম্ভ করিলেন, তখন আমাদের নিজের দেশে এবং বিদেশে বহু সন্দিগ্ধমনা ব্যাক্তি তাঁহাকে উপহাস করিয়াছে, বিদ্রূপ করিয়াছে, কিন্তু তথাপি আমাদের চক্ষের সম্মুখেই অত্যাশ্চর্য যাহা, তাহা ঘটিয়া গেল। সনাতন সংস্কারের কঠিজ পাষাণ বিচূর্ণ হইয়াছে। যে অর্থহীন বিধিনিষেধ আমাদের জাতীয় জীবনকে সংকুচিত করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা ইতিমধ্যেই খসিয়া পড়িতেছে। তাঁহার তপশ্চর্যার ফলে অদ্ভুত কাজ হইয়াছে, কিন্তু অস্পৃশ্যতার পাপ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না করা পর্যন্ত মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বিঘ্ন, আমাদের স্বাধীনতা এবং ন্যায়পরায়ণতার পথের বাধা উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম করিয়া তিনি যদি তাঁহার ব্রত উদ্যাপন করিতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহার এবং আমাদের গৌরব মহত্তর হইবে।
বন্ধুগণ, আপনাদের নিকট আমার এই আবেদন— আপনাদের দেশবাসী যাহারা যুগ যুগ ধরিয়া নীরবে অপমান সহ্য করিয়াছে, যাহারা মূকভাবে অত্যাচারকে মানিয়া লইয়াছে, দেবতাকে স্মরণ করিয়াও যাহারা কখনো ভর্ৎসনা করে নাই, নিজেদের অদৃষ্টকে পর্যন্ত দোষ দেয় নাই, তাহাদের প্রতি প্রীতি এবং ন্যায়বিচারের উদ্যম হইতে বিচ্যুত হইয়া আপনারা আপনাদের মহামানবের প্রতি, আপনাদের অন্তর্নিহিত মানবত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিবেন না। কিন্তু অবশেষে জাতির ভগবৎ-প্রেরিত অধিনায়কের ক্রুদ্ধস্বর আমাদের নিকট পৌঁছিয়াছে। তিনি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন যে, যাহারা গর্বান্ধ হইয়া নিজের— আপনার জনের মধ্যে সামাজিক আদান-প্রদানের স্বাধীনতায় বাধা দেয়, তাহারা স্বাধীনতার মূলোচ্ছেদ করে।