Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)
ব্যক্তি প্রসঙ্গ- পরিশিষ্ট,৯২
পরিশিষ্ট
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
২
২
আমাদের দেশের উপর সবচেয়ে বড়ো শ্ত্রু প্রভুত্ব করিতেছে, তাহা হইতেছে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার, জাতিভেদের গোঁড়ামি ও ধর্মের অন্ধতা। সমুদ্রপারের যে প্রভূত্ব বিদেশীদের মধ্য দিয়া আমাদের উপর শাসন করিতেছে, এই সমস্ত অজ্ঞতা ও সংস্কারের বিদ্বেষ তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি কঠোরতর। এই-সমস্ত অমঙ্গলের যতদিন মূলোচ্ছেদ না হইবে, ততদিন আমরা ভোটের অধিকার ও সুবিধা লাভের প্রত্যাশায় যতই বিবাদ করি-না-কেন, প্রকৃত স্বাধীনতা লাভের এক দৃঢ়তর সংকল্পের সাহস দিয়াছেন— আজ সেই মহাত্মাজীর জন্মতিথিতে আমদিগকে এই কথাগুলিই স্মরণ রাখিতে হইবে। অবশ্য আমরা অনুভব করিতেছি যে, মহাত্মাজী তাঁহার ব্যক্তিগত নৈতিক জীবনের প্রচণ্ড শক্তির দ্বারা সমগ্র দেশের মধ্যে যে আন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছেন এবং ঔদাসীন্য ও আত্মবিস্মৃতির পথ হইতে দুর্জয় সংকল্পের পথে টানিয়া আনিয়াছেন, তাহা একান্তভাবে তাঁহারই সৃষ্ট আন্দোলন; তথাপি আমরা আশা করিতেছি যে, সমগ্র জাতির নিদ্রিত মনের এই জাগরণের ফলে ভারতকে সমস্ত সামাজিক দুর্গতি হইতে উদ্ধারের জন্য সাহায্য করিবে এবং ভারতের পূর্ণতা লাভের পথে যে বাধা আছে, তাহা দূর হইয়া যাইবে।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
৩
৩
আজ মৃত্যুর ভীষণ গম্ভীর মহিমাময় মহাত্মাজীর জন্মদিন আমাদের সম্মুখে প্রতিভাত হইয়াছে। এই মৃত্যুর মহত্ত্ব তাঁহাকে জয়দান করিয়াছে। সাধারণত মানুষ গণ্ডিবদ্ধ পারিপার্শ্বিকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়া তাহার আত্মীয়স্বজনের সহিত গতানুগতিক সম্পর্ক রাখিয়া তাহার অতি সাধারণ জীবনযাত্রা নির্বাহ করে এবং তাহার পর একদিন সে মারা যায়। প্রত্যেক বৎসরেই জীবনের একটি বিশেষ দিন সে উপভোগ করে— সে দিনে সে তাহার অল্প কয়েকজন বন্ধু এবং আত্মীয়ের হৃদয়ে তাহার জন্মগত অধিকারের আসনটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু মহান যে আত্মা, সে বিস্তৃতি জীবনক্ষেত্রে জন্মগ্রহন করে। বহুলোক এবং বিভিন্ন জাতি সেই আত্মাকে স্বীকার করিয়া লয়। তাঁহার জন্মদিন অনুষ্ঠানে আমরা তাঁহাকে আমাদের চিরকালের আপন করিয়াই অনুভব করি না, তাহার মধ্য দিয়া অনুভব করি মানুষের ও জগতের সহিত আমাদের আত্মার আত্মীয়তা।
আজ আমাদের মহৎ সৌভাগ্য এই যে, এইরকম একজন মানুষ আজ আমাদের মধ্যে আসিয়াছেন— আরও সৌভাগ্যের কথা এই যে, আমরা তাঁহাকে অস্বীকার করি নাই! স্বাধীনতা এবং সত্যের অগ্রদূতগণকে আমরা প্রায়শই যেভাবে অস্বীকার করিয়াছি, তাঁহাকে সেরূপ করি নাই— এই আমাদের মহত্তর সৌভাগ্য। তাঁহার প্রভাব ভারতের সর্বত্র— এমন-কি, ভারতের বাহিরেও মানুষকে প্রেরণা দিয়াছে। তাঁহার প্রেরণায় আমাদের মধ্যে সেই সত্য-বোধ জাগিয়াছে, সে সত্য আমাদের স্বার্থসংকীর্ণ বুদ্ধিকে বহুদূরে অতিক্রম করিয়া গিয়াছে। তাঁহার জীবনই আমাদিগকে সেবা-মুক্তি এবং আত্মোৎসর্গের পথে অবিরাম আহ্বান করিতেছে। আজ জাতির পক্ষ হইতে মহাত্মাজীকে মহৎ ভ্রাতা বলিয়া বরণ করিয়া লইবার দিন; কারণ বর্তমান যুগে আমাদের মাতৃভূমিতে তিনিই আমাদের