আমি ভাষার নিজেও যেটুকু চেষ্টা করেছি, তাও তাঁহারই কৃপায়। আমি যে আজ এসেছি তাহার কারণ, আমার সেই আন্তরিক শ্রদ্ধা আজ সকলে সম্মুখে জানালাম। আমি যে তাঁহার কাছে কত ঋণী তাহা স্বীকার করলাম। তিনি যে অস্ত্র ও উপকরণ নিয়ে কাজ করেছিলেন তাহা বড়ো কম— জোর ছিল; তখনও ভাষায় শক্তিসঞ্চার হয় নাই। তিনি তখন সেই দুর্বল উপকরণ নিয়ে কাজ করেছিলেন। সেইগুলিকে তিনি খুব বুঝে—সুজে প্রয়োগ করেছিলেন। পথ ও রথ তৈয়ারি করার মতো তাঁহাকে কত খাটতে হয়েছিল। সেই জন্য তাঁহাকে প্রতিভা ক্ষুণ্ণ করতে হয়েছে। সাহিত্যের মধ্যাহ্ন গগনে আজ তিনি থাকলে অসাধারণ প্রতিভা দ্বারা সকলকে লজ্জা দিতে পারতেন। কিন্তু সেই প্রভাত গগনে তিনি যে সাহিত্যের প্রাণ এনাছিলেন। প্রাণ শক্তি বড়ো কম শক্তি নয়; তিনি ভাষাতে সেই শক্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। তখন ভাষায় ভাবের কাঠামোও ছিল এক, ধারাও ছিল এক— যেমন নাটক লেখা হলে সব ‘বিজয়—বসন্তে’র ছাদে... তিনি সেই ভাষায় সেই ভাবে বৈচিত্র্য এনে দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রাণদানের সঙ্গে সঙ্গে সেই বৈচিত্র্য নানা ভাবে ফুটে উঠেছিল। প্রানসঞ্চারের পরেই নানা প্রকার রূপ সৃষ্টি— আনন্দ রূপ সৃষ্টি হয়। তিনি তখন ভাষার সেই প্রাণে শোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন। আমরা যখন শুয়ে থাকি, ঘুমিয়ে পড়ি, তখন সবাই প্রায় এক— জাগলেই বৈচিত্রের প্রভেদ হয়। আমাদের ভাষায় প্রাণের নূতন জাগরণে পূর্বের একরকমের একঘেয়ের আর আবৃত্তি নাই। সকলেই সজাগ হয়ে [ভাষা] প্রয়োগ করতে পাচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্রই এই নূতন প্রাণের জাগরণ দিয়েছেন। প্রাণ ছোটো হয়ে আসে, পরে বাড়ে। তখন এই প্রাণের এই জাগরণের আয়োতনের— আকার ছোটো ছিল, এখন সেই প্রাণবীজ বড়ো হয়ে উঠেছে। সেই জন্যই তাঁহার প্রতি আজ আমাদের এই নমস্কার- নিবেদন। ভাষায় প্রাণ সকলের চাইতে বড়ো; জাতির প্রাণ অপেক্ষা ভাষার প্রাণ বেশি বড়ো; কাজেই সেই প্রাণদানকারীকে আজ আমাদের সকলের নমস্কার।
২
ভাষা কী ছিল, তাঁর হাতে পড়ে কী হ্ল? তাঁর বঙ্গদর্শনকে এখনকার মাপকাঠিতে দেখলে চলবে না। তখন তা এক অপরূপ সৃষ্টি। প্রতি মাসে এলে বাড়িতে কাড়াকাড়ি। গুরুজনদের কাছ থেকে আমরা পাই কেমন করে?
কী ভাষা নিয়ে বঙ্কিম আরম্ভ করলেন আর কী করে রেখে গেলেন?
তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের ভাষা তো এ নয়। তাঁর সময়কার রুচি ও দৃষ্টি তাঁর লেখার কোথাও ধরা পড়ে না। তিনি (pioneer) যাত্রীদলের অগ্রদূত। নূতন পন্থা রচনায় সৃজনের দুঃসহ দুঃখ তাঁর। তাঁর দুঃখ তোমারা এখন বুঝবে কী করে? তখন বাংলা ছিল সংস্কৃতের দাসী। গরুড়ের মতো তিনি বিনতার দাস্য মোচন করলেন। দাসীবৃত্তি ছাড়লেও যে তার নিজস্ব ঐশ্বর্য তার অন্তরের মধ্যেই নিহিত আছে তা বঙ্কিম দেখিয়ে দিলেন।
বাংলা ভাষাকে তিনি এমন করে রেখে গেলেন যে তা সর্বসাধনা ও ঐশ্বর্যের আধার হতে পারে। নিজে যে সব ঐশ্বর্য আহরণ করে তাতে রেখে দেখলেন যে বাংলা কি অপূর্ব আধার হয়েছে। তাই তো আমরা তাতে আমাদের যা-কিছু সাধনা তা রাখতে পেরেছি।