অ্যাজিটেশন্কারীগণও ভিতরে ভিতরে তাহার আভাস পাইয়াছেন, তাঁহাদের ব্যবহারে এরূপ অনুমান করা যায়। কারণ, এবারে যে নিদারুণ আইনের দ্বারা নাটুহরণ-ব্যাপার ঘটিল সে সম্বন্ধে আমাদের দেশের বাগ্মীসভাসমূহ অভূতপূর্ব বিজ্ঞতাসহকারে সুদীর্ঘকাল নিস্তব্ধ ছিলেন। আমরা গোল করিতে বসিলেই পাছে গবর্মেন্টের মন আরো বিগড়িয়া যায় হয়তো এ আশঙ্কা তাঁহাদের ছিল।
যাহাই হউক, বর্তমান ব্যাপারে আমাদের বিশেষ আনন্দের বিষয় এই যে, গবর্মেন্ট্ প্রজাদের মন রক্ষা করিতে লজ্জা বা সংকোচ বোধ করেন নাই। গবর্মেন্ট্ এবং এ-দেশী ইংরাজ-সম্প্রদায় বলিতেছেন যে, প্রজারা যখন পুব-দেশী, এবং পরিবারমন্ডলীর প্রতি হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে উহাদের যখন এতই দৃঢ় সংস্কার, তখন সেটা বিবেচনা করিয়া এবং যথাসম্ভব বাঁচাইয়া কাজ করাই রাজার কর্তব্য।
আমাদের বিস্ময় এবং কৃতজ্ঞতার কারণ এই যে, প্লেগ-দমন একমাএ ভারতবর্ষের হিতের জন্য নহে। তাহাতে ইংরাজের ভয় আছে, বাণিজ্যের ক্ষতি আছে। এরূপ স্থলে প্রজাদের পুব-দেশী সংস্কার বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে গণ্য হওয়ার প্রাচীলক্ষ্মীর সকরুণ নেত্রযুগল আনন্দাশ্রুজলে অভিষিক্ত হইয়া উঠিয়াছে।
এমন অকস্মাৎ সৌভাগ্য আমরা আশাও করি নাই। কারণ, যে দুর্ভিক্ষ-ভূকম্প-মহামারীর প্রলয়পীড়নে অন্য কোনো দেশ আসন্ন মৃত্যুর ভীষণ নৈরাশ্যে উদ্দাম হইয়া উঠিত, ভারতবর্ষ তাহা অবিচলিত ধৈর্য-সহকারে সহ্য করিয়াও কর্তৃপক্ষের করুণা আকর্ষণ করিতে পারে নাই। দেশের এই পরম দুঃসময়ে গবর্মেন্ট্ উপর্যুপরি তাঁহার কঠোরতম বিধি ও শাসনের দ্বারা ভারতবর্ষীয় সহিষ্ণুতার অগ্নিপরীক্ষা সৃজন করিয়া তুলিয়াছিলেন।
এইরূপ দুর্যোগই বিদেশী রাজার পক্ষে প্রজাদের হৃদয়জয়ের দুর্লভ অবকাশ। এই সময়েই রাজা প্রমাণ করিতে পারেন যে, আমরা পর হইয়াও পর নহি। এই সময়ে তাঁহাদের পক্ষে ক্ষমা ধৈর্য ও সমবেদনা— ফৌজ কেল্লা ও গুলিগোলার অপেক্ষা রাজশক্তির যথার্থ পরিচয়স্থল।
পরন্তু এই সময়ে পতিতের উপর পদপ্রহার, ব্যথিতের উপর জবর্দস্তি— ভয়ের নিষ্ঠুরতা মাত্র। ইহাতে রাজার রাজশক্তি নহে, বিদেশীর দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এবার প্যুনিটিভ পুলিস, নাটু-নিগ্রহ, সিডিশন-বিলের দ্বারা গবর্মেণ্ট্ উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করিয়াছেন যে, আমরা স্বল্পসংখ্যক বিদেশী, আমরা ক্ষমা করিতে সাহস করি না।
মারীগ্রস্ত পুনা যখন গোরা সৈন্যের আতঙ্কে মুহুর্মুহু কাতরোক্তি প্রকাশ করিতে লাগিল তখন কর্তৃপক্ষ সেই আর্তনাদকে প্রজার স্পর্ধা বলিয়া গণ্য করিলেন। তখন তাঁহারা প্রবলজনোচিত ঔদার্য অবলম্বন করিলেন না; সকরুণচিত্তে এটুকু বিবেচনা করিলেন না যে, দুর্ভাগাগণের অন্তিমশয্যা হইতে অন্তত একটা অসংগত বিভীষিকা দূর করিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই। স্বীকার করিলাম, গোরা সৈন্যগণ
শিষ্ট শান্ত সংযত এবং দেশীয় লোকদের প্রতি স্নেহশীল। কিন্তু দেশের মূঢ় লোকের যদি এমন-একটা সুদৃঢ় অন্ধ সংস্কার জন্মিয়াই থাকে যে, গোরা সৈন্য দুর্দান্ত উচ্ছৃঙ্খল এবং শ্রদ্ধা অভাবে দেশীয় লোকের প্রতি অবিবেকী, তবে সেই চরম সংকটের সময় বিপন্ন ব্যক্তিদের একটা অনুনয় রক্ষা করিলে, দুর্বলতা নহে, মহত্ত্ব প্রকাশ পাইত।
দেখিলাম, গবর্মেন্টের উত্তরোত্তর রাগ ও জেদ বাড়িয়া যাইতে লাগিল। যেখানে যত বেদনা শাসনকর্তা সেখানে তত আঘাত করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। ভারতবর্ষের আদ্যন্তমধ্যে অশান্তির আক্ষেপ কোথাও প্রকাশ্যে ফুটিবার উপক্রম করিল, কোথাও গোপনে