আমরা যদি রাজপুরুষগণকে এমন কথা বুঝাইতে পারি যে, ন্যায়পথ লঙ্ঘন করিলে সেটাকে আমরা বাহাদুরি জ্ঞান করি না, অন্যায় যতই বলিষ্ঠ দেখিতে হউক আমাদের প্রাচ্য স্বভাবেও তাহা ঘৃণ্য এবং নিন্দনীয় বলিয়া অনুভূত হয়, এবং সুদৃঢ় নিরপেক্ষ ভাবে সর্বত্র সর্বলোকের প্রতি যথোচিত ন্যায়দন্ড বিধান করিবার সাহস না থাকা আমাদের নিকট দুর্বলতা বলিয়াই প্রতিভাত হইয়া থাকে, তবে আমাদের সেই কর্তব্যজ্ঞানের আদর্শকে ইংরাজ সম্মান না করিয়া থাকিতে পারিবেন না, কারণ সে আদর্শের সহিত তাঁহাদের নিজেদের আদর্শের ঐক্য দেখিতে পাইবেন।
যখন আমরা বহুকালব্যাপী পরাধীনতার বিষময় শিক্ষা ভুলিতে পারিব, যখন প্রবলের অন্যায়াচরণকে বিধির বিধানের স্বরূপ নীরবে অবশ্যসহ্য বলিয়া স্থির করিব না, যখন অন্যায়ের প্রতিবিধান-চেষ্টা নিষ্ফল হইলেও তাহাকে কর্তব্য বলিয়া জানিব এবং সেজন্য ত্যাগ স্বীকার ও কষ্ট সহ্য করিতে পরাঙ্মুখ হইব না, তখন আমাদের যথার্থ আনন্দের দিন উপস্থিত হইবে। তখন ব্রিটিশ গবর্মেন্টের ন্যায়পরতা কদাচ স্বার্থ পলিসি এবং ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালের দ্বারা বিচলিত হইবে না, অটল পর্বতের ন্যায় প্রজাহৃদয়ের দৃঢ়ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত হইবে। তখন ইংরাজের সদ্ব্যবহার শুভদৈবক্রমে ক্ষণিক অনুগ্রহের ন্যায় আমাদের নত মস্তকের উপর নিক্ষিপ্ত হইবে না, সম্মানের ন্যায় আমাদের নিকট আহরিত হইবে; আজ যাহা ভিক্ষাস্বরূপে প্রাপ্ত হইতেছি তখন তাহা অধিকারের ন্যায় গ্রহণ করিব।
প্রশ্ন উঠিতে পারে— উপদেশ সহজ, কিন্তু উপায়টা কী। তাহার উত্তরে বলিতে হয়, কোনো যথার্থ মঙ্গল কলকৌশলের দ্বারা পাওয়া যায় না; তাহার যা মূল্য তাহা সমস্তটাই দিতে হইবে, প্রত্যেককে প্রাণপণ করিতে হইবে, ঘরে ঘরে ভ্রাতা এবং সন্তানদিগকে শিক্ষা দিতে হইবে, পরিবার এবং সমাজের মধ্যে ন্যায়াচরণের অটল আদর্শ স্থাপন করিতে হইবে, নিজের ব্যবহারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে। সমস্ত ভালো কথার ন্যায় এ কথাটিও শুনিতে সহজ, করিতে কঠিন, এবং অত্যন্ত পুরাতন। কিন্তু এই পুরাতন সুদীর্ঘ প্রকাশ্য পথ ছাড়া স্থায়ী কল্যাণের আর কোনো নূতন সংক্ষিপ্ত গূঢ় পথ আবিষ্কৃত হয় নাই।
কলিকাতায় প্লেগ-রেগ্যুলেশন যে উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া উঠে নাই সেজন্য আমাদের নব বঙ্গাধিপের প্রতি বঙ্গদেশের কৃতজ্ঞতা উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে।
যমদূতের উৎপীড়নের সহিত রাজদূতের বিভীষিকার যোগ হইলে প্রজাগণ একেবারে হতাশ হইয়া পড়িত। কিন্তু সেইটে নিবারণ হইয়াছে বলিয়াই যে একমাত্র আনন্দ তাহা নহে; ইহা অপেক্ষা গুরুতর সুখের কথা আছে।
ইতিপূর্বে আমরা লক্ষ করিয়া দেখিয়াছি, প্রজারা যখন কোনো-একটা বিষয়ে একটু বেশি জিদ করিয়া বসে তখন গবর্মেন্ট্ তাহাদের অনুরোধ পালন করিতে বিশেষ কুণ্ঠিত হইয়া থাকেন— পাছে প্রজা প্রশ্রয় পায়।
সেইজন্য আমাদের শিক্ষিত লোকেরা যে-সমস্ত কোলাহলকে পোলিটিকাল অ্যাজিটেশন্ নাম দিয়া থাকেন তাহাকে উদ্দেশ্যসিদ্ধির পক্ষে আমরা সদুপায় বলিয়া মনে করি না। কারণ, গবর্মেন্ট্ এবং ভারতবর্ষীয় ইংরাজগণ যখন এই-সকল