ইংরাজ হঠাৎ কন্গ্রেসের মূর্তি দেখিয়া প্রথমটা আচমকা ডরাইয়া উঠিয়াছিল। তাহার কারণ, মানুষ চিরসংস্কার-বশত স্বদেশী জুজুকে যতটা ভয় করে, বিদেশী বিভীষিকাকে ততটা নহে। এইজন্য ভারতবর্ষের সুখশয়নাগারে হঠাৎ সেই পোলিটিকাল জুজুর আবির্ভাব দেখিয়া ইংরাজের সুস্থ প্লীহাও চমকিয়া উঠিয়াছিল।
কিন্তু কন্গ্রেসটার উপরে প্রত্যক্ষভাবে কোনোরূপে আঘাত করা হয় নাই। তাহার কারণ, ঢাকের উপরে ঘা মারিলে ঢাক আরো বেশি করিয়া বাজিয়া উঠে। কন্গ্রেসের আর-কোনো ক্ষমতা থাক্ বা না থাক্, গলার জোর আছে— তাহার শব্দ সমুদ্রপার পর্যন্ত গিয়া পৌঁছে।
সুতরাং এই নবনির্মিত জাতীয় জয়ঢাকটার উপরে কাঠি না মারিয়া তাহাকে তলে তলে ছিদ্র করিবার আয়োজন করা হইল। মুসলমানেরা প্রথমে কন্গ্রেসে যোগ দিবার উপক্রম করিয়া সহসা যে বিমুখ হইয়া দাঁড়াইল তাহার কারন বোঝা নিতান্ত কঠিন নহে— এবং পাঠকদের নিকট সে কারণ স্পষ্ট করিয়া নির্দেশ করা অনাবশ্যক বোধ করি।
কিন্তু এতদিনে ইংরাজ এ কথা কতকটা বুঝিয়া থাকিবে যে, হিন্দুর হস্তে পলিটিক্স্ তেমন মারাত্মক নহে। আবহমান কালের ইতিহাস অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেও ভারতবর্ষে পোলিটিকাল ঐক্যের কোনো লক্ষণ কোনোকালে দৃষ্টিগোচর হয় না। ঐক্য কাহাকে বলে মুসলমান তাহা জানে এবং পলিটিক্স্ও তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ নহে; মুসলমান যদি দূরে থাকে তবে কন্গ্রেস হইতে আশু আশঙ্কার কোনো কারণ নাই।
হিন্দুজাতির প্রতি পলিটিক্সের প্রভাব যে তেমন প্রবল নহে কন্গ্রেসই তাহার প্রমানস্থল হইবার উপক্রম করিতেছে। যতই দিন যাইতেছে ততই কন্গ্রেসঅর্থাভাবে দরিদ্র এবং উৎসাহাভাবে দুর্বলের মতো প্রতিভাত হইতেছে। ইংরাজও সম্প্রতি কিছু যেন নিশ্চিন্ত বোধ করিতেছে।
কিন্তু ইতিমধ্যে ইংরাজের ভারতশাসনক্ষেত্রে আর-একটা নূতন ভয় আসিয়া দেখা দিয়াছে। সেটা আর কিছু নয়, গোরক্ষণী সভা। যাহাদিগকে রক্ষা করিবার জন্য এই সভাটা স্থাপন করা হইয়াছে তাহারা যতটা নিরীহ, সভাটাকে ততটা নিরীহ বলিয়া ইংরাজের ধারণা হইল না।
কারণ, ইংরাজ ইহা বুঝিয়াছে যে স্বদেশ ও স্বজাতি -রক্ষার জন্য যে হিন্দু এক হইতে পারে না, গোষ্ঠ এবং গোজাতি -রক্ষার জন্য চাইকি তাহারা এক হইতেও পারে। স্বাধীনতা স্বদেশ আত্মসন্মান মনুষ্যত্ব প্রভৃতি অনেক শ্রেষ্ঠতর পদার্থের অপেক্ষা গোরুকে রক্ষা করা যে আমাদের পরমতর কর্তব্য, এ কথা হিন্দু ভূপতি হইতে কৃষক পর্যন্ত সকলেই সহজে বুঝিবে। গোহত্যা-নিবারণ সম্বন্ধে নেপালের গুর্খা হইতে পঞ্জাবের শিখ পর্যন্ত একমত।
এই কারনে গোরক্ষণী সভটা ইংরাজের পক্ষে কিছু বিশেষ আতঙ্কজনক হইতে পারে। ফলেও তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে।
প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, কিন্তু প্রমাণ দেওয়া কিছু কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। সম্প্রতি ভ্রমণোপলক্ষে পশ্চিম-ভারতে গিয়া দেখিয়াছি, গোরক্ষার জন্য লোকে আর ততটা ব্যস্ত নহে— এখন গোরক্ষকগণ রক্ষা পাইলে হয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সকলে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে বটে, তবু মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতেছে না। যে-সকল কথা ঘরে ঘরে আলোচিত হইতেছে সে-সকল কথা যদি প্রকাশ হইত তবে কী হইত। যে প্রকাশ করিত তাহাকে সম্ভবত নির্দিষ্ট রাজ-অট্টালিকায় রাজপ্রহরীগণ-কর্তৃক বেষ্টিত হইয়া বাস করিতে হইত। গোরুও সময়ে সময়ে সকরুণ হাম্বারব করে, বাঙালিও সময়ে সময়ে বেশী-বিদেশী ভাষায় আর্তনাদ করিয়া থাকে। কিন্তু পশ্চিম-ভারত একেবারে মূক।