Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


পরিশিষ্ট -কবিতা-পুস্তক- ১
কবিতা-পুস্তক
শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত
সকল পুস্তকের উদ্দেশ্যেই হয় জ্ঞান না-হয় আমোদ না-হয় উভয়ের সম্মিশ্র। এখানে আমোদ শব্দটি আমরা অতি প্রশস্তভাবে ব্যবহার করিতেছি। ডিকুইন্সি বলেন যে উচ্চ অঙ্গের কাব্য বা নাটক পড়িয়া আমরা আমোদ পাই—এ কথা বলিতে গেলে সে-সকল কাব্য নাটকের অবমাননা করা হয়; তিনি বলেন আমাদের হৃদয়ের নিভৃত্ত বিজনে অনেক মহান্ ভাব এমন সুষুপ্ত ভাবে অবস্থান করে যে প্রাত্যহিক জীবনের কোনো ঘটনাই তাহাদিগকে জাগাইয়া দিতে পারে না—কিন্তু প্রকৃত কবিদের কাব্য পাঠ করিতে করিতে সেই-সকল ভাব জাগরিত হইয়া উঠে এবং আমরা এই দীন হীন ক্ষদ্র জীব হইতে যে প্রকৃত পক্ষে কত দূর উচ্চপদবীগত তাহার প্রতি আমাদের চেতন হয়। এ স্থলে সেই-সকল কাব্যগুলিকে আমোদ বা জ্ঞানপ্রদ বলা অপেক্ষা শক্তিপ্রদ বলা উচিত। কিন্তু ডিকুইন্সির উত্তরে আমরা বলি যে ওই শক্তিপ্রদ গুণটি উচ্চ-অঙ্গের জ্ঞান ও আমোদের সমষ্টি বলিলে কোনো দোষ হয় না। এ বিষয়ে তর্ক না তুলিয়া আমরা এই সিদ্ধান্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইলাম যে সকল পুস্তকের উদ্দেশ্যই প্রশস্ত ভাবে জ্ঞান কিংবা আমোদ কিংবা উভয়ের সমষ্টি। এই সিদ্ধান্তটি মনে রাখিলে অনেক পুস্তকের সমালোচনা সহজ হইয়া পড়ে।– এই সিদ্ধান্তটির উপর দৃষ্টি রাখিয়াই আমরা বলিতে বাধ্য হইলাম যে বঙ্কিমবাবুর কবিতা-পুস্তক আমাদিগের ভালো লাগিল না—জ্ঞানের কথা এ স্থলে উল্লেখ করাই বাহুল্য মাত্র, কিন্তু আমোদ—সাধারণ, সামান্য, অকিঞ্চিৎকর আমোদ পর্যন্ত এ পুস্তকের কোনো স্থল পাঠ করিয়া আমরা পাইলাম না—বঙ্কিমবাবুর কোনো গ্রন্থই যে এরূপ নীরস, নির্জীব, স্বাদগন্ধহীন—কিছুই না—হইবে, তাহা আমরা কখনো স্বপ্নেও ভাবি নাই।

প্রথম কবিতা পৃথ্বীরাজ-মহিষী সংযুক্তার বিষয়। বিষয়টি অতিশয় উচ্চ ও মহৎ। পৃথ্বীরাজ দুঃস্বপ্ন দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন—সেই দুঃস্বপ্ন যবন-কর্তৃক ভারত-বিজয়ের আভাস মাত্র, ক্রমে সেই স্বপ্ন প্রকৃত ঘটনায় পরিণত হইল—ঘোরির মহম্মদ আসিয়া স্থানেশ্বরে হিন্দুরাজকে পরাভব করিলেন, সংযুক্তা নিরুপায় হইয়া চিতারোহণ করিলেন।– এই বিষয়টির উপর যদি একজন প্রকৃত কবির কল্পনা খেলিতে পাইত, তাহা হইলে ইহাকে সূর্যকিরণসংযুক্ত স্ফটিকের ন্যায় নানা বর্ণে সুরঞ্জিত করিতে পারিত, কিন্তু বঙ্কিমবাবু যেন পরীক্ষা স্থলে ‘সংযুক্তা কে ছিল’—‘স্থানেশ্বরের যুদ্ধে কী হইল’ এবং ‘সংযুক্তা কী রূপে মরিল’—এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন। সমস্ত কদিতাটিতে এমন একটি ভাব নাই, এমন একটি কথা নাই, যাহাতে হৃদয় নাচিয়া উঠে, যাহাতে ধমনী দিয়া রক্ত প্রবলতর বেগে প্রবাহিত হয়—যাহাতে আর্য-গৌরবের কণামাত্রও কল্পনার চক্ষে বিভাসিত হয়।– অনর্থক শব্দ আড়ম্বরে কবিতাটির কায়া বৃদ্ধি হইয়াছে—অসংগত-মেদ-স্ফীত রোগীর ন্যায় ইহার লাবণ্য-শ্রী নাই—জীবনের আভাস মাত্রও আছে কি না সন্দেহ। পৃথ্বীরাজ দুঃস্বপ্ন দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলেন—মহিষীকে স্বপ্নের কথা ও আশঙ্কিত উৎপাতের কথা বলিয়া দুঃখে ও ভয়ে নিবেদন করিলেন

‘ বার বার বুঝি   এই বার শেষ!

   পৃথ্বীরাজ নাম বুঝি না রয় '।

তখন

‘ শুনি পতিবাণী,                 যুড়ি দুই পাণি

জয় জয় জয়!           বলে রাজরানী

জয় জয় জয়             পৃথ্বীরাজে জয়