Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)
বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য, ১২
বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য
ভাবিনু কাতর স্বরে কহিব তাঁহারে-
‘প্রতি রক্তবিন্দু মোর কাঁপিছে শিরায়,
পুরানো সে অগ্নি পুন উঠিছে জ্বলিয়া।’
হা–বর্জিল কোথা–হয়েছেন অন্তর্ধান!
প্রিয়তম পিতা তুমি বর্জিল আমার!
দান্তেকে বর্জিলের এই সহসা অন্তর্ধানে ব্যথিত হইয়া কাঁদিতে দেখিয়া বিয়াত্রিচে কহিলেন যে ‘দান্তে, কাঁদিয়ো না, ইহা অপেক্ষা তীক্ষ্মতর ছুরিকা তোমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইবে ও তাহার যন্ত্রণায় তোমাকে কাঁদিতে হইবে।’ সুরবালারা পুষ্পবৃষ্টি স্থগিত করিলেন ও পুষ্প-মেঘ-মুক্ত সূর্য প্রকাশ পাইলেন। বিয়াত্রিচে সেই উচ্চ রথের উপরি হইতে কহিলেন, ‘চাহিয়া দেখো, আমি বিয়াত্রিচে।’ বিয়াত্রিচের সেই ‘অটল মহিমায়’ দান্তে ‘জননীর সম্মুখে ভীত সন্তানের’ ন্যায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন। বিয়াত্রিচে তখন তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, অল্পবয়সে দান্তের হৃদয় ধর্মে ভূষিত ছিল, বিয়াত্রিচে তাঁহার যৌবনময় চক্ষের আলোকে তাঁহাকে সর্বদাই সৎপথে লইয়া যাইতেন। কিন্তু তিনি যখন তাঁহার মর্ত্যদেহ পরিত্যাগ করিয়া অমর দেহ ধারণ করিলেন, যখন ধুলি-আবরণ হইতে মুক্ত হইয়া পূণ্য ও সৌন্দর্যে অধিকতর ভূষিত হইলেন, তখন তাঁহার প্রতি দান্তের সে ভালোবাসা কমিয়া গেল। বিয়াত্রিচের তীব্র ভর্ৎসনায় তিনি অতিশয় যন্ত্রণা পাইলেন। পরে অনুতাপ-অশ্রু বর্ষণ করিয়া ও স্বর্গের নদীতে স্নান করিয়া তিনি পাপ-বিমুক্ত হইলেন। তখন তিনি তাঁহার প্রিয়তমা সঙ্গিনীর সহিত স্বর্গ দর্শনে চলিলেন। যখন স্বর্গনরক পরিভ্রমণ করা শেষ হইল, তখন কবি কহিলেন-
জাগি উঠি স্বপ্ন যদি ভুলে যাই সব,
তবু তার ভাব যেমন থাকে মনে মনে,
তেমনি আমারো হল, স্বপ্ন গেল ছুটে
মাধুর্য তবুও তার রহিল হৃদয়ে।