Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


মেঘনাদবধ কাব্য, ৬
মেঘনাদবধ কাব্য

ভ্রূকুটি করিয়া দর্পে ইন্দ্রাসন-‘পরে

বসিল, কাঁপিল গৃহ দৈত্যপদভরে।

মেঘনাদবধের প্রথম সর্গের উপসংহার ভাগে যখন ইন্দ্রজিৎ রাবণের নিকট যুদ্ধে যাইবার প্রার্থনা করিলেন, তখন রাবণ কহিলেন, ‘এ কাল সমরে নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা বারংবার’। কিন্তু বৃত্রপুত্র রুদ্রপীড় যখন পিতার নিকট সেনাপতি হইবার প্রার্থনা করিলেন তখন বৃত্র কহিলেন,

রুদ্রপীড়! তব চিত্তে যত অভিলাষ,

পূর্ণ কর যশোরশ্মি বাঁধিয়া কিরীটে;

বাসনা আমার নাই করিতে হরণ

তোমার সে যশঃপ্রভা পুত্র যশোধর!

ত্রিলোকে হয়েছ ধন্য, আরও ধন্য হও

দৈত্যকুল উজ্জ্বলিয়া, দানবতিলক!

তবে যে বৃত্রের চিত্রে সমরের সাধ

অদ্যাপি প্রজ্বল এত, হেতু সে তাহার

যশোলিপ্সা নহে, পুত্র, অন্য সে লালসা,

নারি ব্যক্ত করিবারে বাক্যে বিন্যাসিয়া।

অনন্ত তরঙ্গময় সাগর গর্জন,

বেলাগর্ভে দাঁড়াইলে, যথা সুখকর;

গভীর শর্বরীযোগে গাঢ় ঘনঘটা

বিদ্যুতে বিদীর্ণ হয়, দেখিলে যে সুখ;

কিংবা সে গঙ্গোত্রীপার্শ্বে একাকী দাঁড়ায়ে

নিরখি যখন অম্বুরাশি ঘোর-নাদে

পড়িছে পর্বতশৃঙ্গ স্রোতে বিলুণ্ঠিয়া,

ধরাধর ধরাতল করিয়া কম্পিত!

তখন অন্তরে যথা, শরীর পুলকি,

দুর্জয় উৎসাহে হয় সুখ বিমিশ্রিত;

সমরতরঙ্গে পশি, খেলি যদি সদা,

সেই সুখ চিত্তে মম হয় রে উত্থিত।

ইহার মধ্যে ভয়ভাবনা কিছুই নাই, বীরোচিত তেজ। মেঘনাদবধ কাব্যে অনেকগুলি ‘প্রভঞ্জন’ ‘কলম্বকুল’ প্রভৃতি দীর্ঘপ্রস্থ কথায় সজ্জিত ছত্রসমূহ পাঠ করিয়া তোমার মন ভারগ্রস্ত হইয়া যাইবে, কিন্তু এমন ভাবপ্রধান বীরোচিত বাক্য অল্পই খুঁজিয়া পাইবে। অনেক পাঠকের স্বভাব আছে যে তাঁহারা চরিত্রে চিত্রে কী অভাব কী হীনতা আছে তাহা দেখিবেন না, কথার আড়ম্বরে তাঁহারা ভাসিয়া যান, কবিতার হৃদয় দেখেন না, কবিতার শরীর দেখেন। তাঁহারা রাবণের ক্রন্দন অশ্রু আকর্ষণ করিলেই তৃপ্ত হন, কিন্তু রাবণের ক্রন্দন করা উচিত কি না তাহা দেখিতে চান না, এইজন্যই বঙ্গদেশময় মেঘনাদবধের এত সুখ্যাতি। আমরা দেখিতেছি কোনো কোনো পাঠক ভাবিয়া ভাবিয়া মাথা ঘুরাইবেন যে, সমালোচক রাবণকে কেন তাহার কাঁদিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে চাহেন? একজন চিত্রকর একটি কালীর মূর্তি