সৌন্দর্য অন্ন নহে, বস্ত্র নহে, তাহা কাহারও পক্ষে প্রত্যক্ষরূপে আবশ্যক নহে।
তাহা আবশ্যকের অতিরিক্ত দান, তাহা ঈশ্বরের প্রেম।
যাহা কেবলমাত্র আবশ্যক–যাহা নহিলে নয় বলিয়া চাই, তাহাতে আমাদের দারিদ্র্য স্মরণ করাইয়া দেয়। এইজন্য তাহার প্রতি আমরা অনেক সময় অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া আপনার মর্যাদা উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করি। উদরপূর্তিকে আমরা হাতে কলমে অবহেলা করিতে পারি না, কিন্তু মুখে তাহার প্রতি যথেষ্ট দূরছাই প্রয়োগ করি। বুদ্ধি-চর্চার আনন্দকে আমরা উচ্চতর আসন দিই। তাহার একটা কারণ, উদরচর্চা অপেক্ষা বুদ্ধিচর্চা অধিকতর পরিমাণে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। বিদ্যালোচনা না করিলে তুমি মুর্খ হইবে কিন্তু মারা পড়িবে না।
সংসারে যদি কেবল নির্জল আবশ্যকটুকুমাত্র থাকিত তবে আমরা জগদীশ্বরের দ্বারে ভিক্ষুকরূপে থাকিতাম। তাহা হইলে আমাদিগকে নিতান্তই কেবল দায়ে ফেলিয়া রাখা হইত।
সঙ্গে সঙ্গে প্রেম থাকিলে ভিক্ষা আর ভিক্ষাই থাকে না, যেমন জননীর নিকট হইতে অভাব মোচন।
সৌন্দর্য সেই প্রেমের লক্ষণ, আমাদের মন ভুলাইবার চেষ্টা। যদি সংসারে কাজ লওয়াই উদ্দেশ্য হয় তবে আমাদের মনোহরণের চেষ্টা বাহুল্য। জগতের বড়ো বড়ো দানব-শক্তির মাঝখানে ক্ষুদ্র প্রাণীদের নিকট হইতে অনায়াসে কান ধরিয়া কাজ আদায় করিয়া লওয়া যাইতে পারিত। জগতের সৌন্দর্য বাপুবাছা বলিয়া আমাদের গায়ে হাত বুলাইতেছে কেন?
ওইখানেই যন্ত্রনিয়মের উপরে প্রেমের নিয়ম দেখা দিতেছে। খাদ্যের সহিত রস, শব্দের সহিত সংগীত, দৃশ্যের সহিত আকার ও বর্ণসুষমা, হইতেই প্রেমের হাত দেখা যায়।
আমরা টিকিয়া থাকিব প্রকৃতির আত্মরক্ষার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট, কিন্তু আনন্দে থাকিব ইহা বাড়ার ভাগ-বিশেষত তাহার জন্য আয়োজন তো কম করিতে হয় নাই! গ্রহতারা তো বেশ চলিতেছে, গাছপালা তো বেশ স্বাদহীন আহার করিয়া অন্ধ ও বধির ভাবে বংশবৃদ্ধি করিতেছে! কিন্তু যেখানেই চেতনার সঞ্চার করা হইয়াছে সেইখানেই কেবলমাত্র শক্তি নহে, তদতিরিক্ত প্রেম অনুভব করানো হইতেছে। শক্তিকে মধুর করিয়া তুলিবার চেষ্টা দেখা যাইতেছে।
শক্তির মধ্যে কার্যকারণশৃঙ্খলা দেখা যায়–এইজন্য তাহা কিয়ৎ-পরিমাণে বিজ্ঞানের আয়ত্ম। কিন্তু সৌন্দর্যের মধ্যে ইচ্ছা দেখা যায়, এইজন্য বিজ্ঞান সেখানে প্রতিহত। এইজন্য সৌন্দর্য অতীব আশ্চর্য রহস্যময়।
এইজন্য সৌন্দর্য অনাবশ্যক হইয়াও আমাদের আত্মার মধ্যে আলোড়ন উপস্থিত করে। যেন ওইখানে অনন্তের সহিত আমাদের নাড়ির টান উপলব্ধি করা যায়।
সৌন্দর্য সৃষ্টির সর্বকনিষ্ঠ, দুর্বল, সুকুমার। কিন্তু তাহাকে সকল বলের উপরিভাগে প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। কঠিন গ্রানিটের ভিত্তির উপরে কোমল ধরণীর শ্যামল লাবণ্য। প্রবল গুঁড়ি ও ডালপালার উপরে সুন্দর পুষ্পপল্লব। কঠোর অস্থি-মাংসপেশীর উপরে সুকুমার দেহসৌন্দর্যের বিস্তার। উৎকট পুরুষবলের উপরে অবলা রমণী পুষ্পের মতো প্রস্ফুটিত।
স্বাধীনতাও সৃষ্টির সর্বশেষ সন্তান। মানবই আপন অন্তরে স্বাধীনতা অনুভব করিয়াছে। স্বাধীন আত্মার নিকটে এই দুর্বল সৌন্দর্যের বল সর্বাপেক্ষা অধিক। বলের প্রতিকূলে আমরা বল প্রয়োগ করি। সৌন্দর্যের কাছে আমরা আত্মবিসর্জন করি। সে আমাদের