আমি কে তাই আমি জানলেম না,
আমি আমি করি কিন্তু, আমি আমার ঠিক হইল না।
কড়ায় কড়ায় কড়ি গণি
চার কড়ায় এক গণ্ডা গণি,
কোথা হইতে এলাম আমি তারে কই গণি!
যাঁহাদের প্রাণ বিদেশী হইয়া গিয়াছে, তাঁহারা কথায় কথায় বলেন– ভাব সর্ব্বত্রই সমান। জাতিবিশেষের বিশেষ সম্পত্তি কিছুই নাই! কথাটা শুনিতে বেশ উদার, প্রশস্ত। কিন্তু আমাদের মনে একটি সন্দেহ আছে। আমাদের মনে হয়, যাহার নিজের কিছু নাই, সে পরের স্বত্ব লোপ করিতে চায়। উপরে যে মতটি প্রকাশিত হইল, তাহা চৌর্য্যবৃত্তির একটি সুশ্রাব্য ছুতা বলিয়া বোধ হয়। যাঁহারা ইংরাজি হইতে দুই হাতে লুট করিতে থাকেন, বাঙ্গালাটাকে এমন করিয়া তোলেন যাহাতে তাহাকে আর ঘরের লোক বলিয়া মনে হয় না, তাহারাই বলেন ভাষাবিশেষের নিজস্ব কিছুই নাই, তাঁহারাই অম্লান বদনে পরের সোনা কানে দিয়া বেড়ান। আমারই যে নিজের সোনা আছে এমন নয়, কিন্তু তাই বলিয়া একটা মতের দোহাই দিয়া সোনাটাকে নিজের বলিয়া জাঁক করিয়া বেড়াই না। ভিক্ষা করিয়া থাকি, তাতেই মনে মনে ধিক্কার জন্মে, কিন্তু অমন করিলে যে স্পষ্ট চুরি করা হয়।
সাম্য এবং বৈষম্য, দুটাকেই হিসাবের মধ্যে আনা চাই। বৈষম্য না থাকিলে জগৎ টিকিতেই পারে না। সব মানুষ সমান বটে, অথচ সব মানুষ আলাদা। দুটো মানুষ ঠিক এক ছাঁচের, এক ভাবের পাওয়া অসমম্ভব, ইহা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না। তেমনি দুইটি স্বতন্ত্র জাতির মধ্যে মনুষ্যস্বভাবের সাম্যও আছে, বৈষম্যও আছে। আছে বলিয়াই রক্ষা, তাই সাহিত্যে আদান-প্রদান বাণিজ্য-ব্যবসায় চলে। উত্তাপ যদি সর্ব্বত্র একাকার হইয়া যায়, তাহা হইলে হাওয়া খেলায় না, নদী বহে না প্রাণ টেকে না। একাকার হইয়া যাওয়ার অর্থই পঞ্চত্ব পাওয়া। অতএব আমাদের সাহিত্য যদি বাঁচিতে চায়, তবে ভাল করিয়া বাঙ্গালা হইতে শিখুক।
ভাবের ভাষার অনুবাদ চলে না। ছাঁচে ঢালিয়া শুষ্ক জ্ঞানের ভাষায় প্রতিরূপ নির্ম্মাণ করা যায়। কিন্তু ভাবের ভাষা হৃদয়ের স্তন্য পান করিয়া, হৃদয়ের সুখদুঃখের দোলায় দুলিয়া মানুষ হইতে থাকে। সুতরাং তাহার জীবন আছে। ছাঁচে ঢালিয়া তাহার একটা নির্জ্জীব প্রতিমা নির্ম্মাণ করা যাইতে পারে, কিন্তু তাহা চলিয়া ফিরিয়া বেড়ইতে পারে না, ও হৃদয়ের মধ্যে পাষাণভারের মত চাপিয়া পড়িয়া থাকে। Force of gravitation -কে ভারাকর্ষণ শক্তি বলিলে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু ইংরাজিতে liberty ও freedom শব্দে যে ভাবটি মনে আসে, বাঙ্গালায় স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য শব্দে ঠিক সে ভাবটি আসে না –কোথায় একটুখানি তফাৎ পড়ে। ইংরাজীতে যেখানে বলে “free as mountain air”,আমরা যদি সেইখানে বলি “পর্ব্বতের বাতাসের মত স্বাধীন”, তাহা হইলে কি কথাটা প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করে? আমরা আজকাল ইংরাজির ভাবের ভাষাকে বাঙ্গালায় অনুবাদ করিতেছি- মনে করিতেছি ইংরাজি ভাবটি বুঝি ঠিক বজায় রাখিলাম– কিন্তু তাহার প্রমাণ কি? আমাদের সাহিত্যে এখন ইংরাজি-ওয়ালারা যাহা লেখেন, ইংরাজি-ওয়ালারাই তাহা পড়েন, ভাবগুলিকে মনে মনে ইংরাজিতে অনুবাদ করিয়া লন– তাঁহাদের যাহা কিছু ভাল লাগে, ইংরাজির সহিত মিলিতেছে মনে করিয় ভাল লাগে। কিন্তু যে ব্যক্তি ইংরাজি বুঝে না সে ব্যক্তিকে ঐ লেখা পড়িতে দাও, কথাগুলি তাহার প্রাণের মধ্যে যদি প্রবেশ করিতে পারে তবেই বুঝিলাম যে, হাঁ, ইংরাজি ভাবটা বাঙ্গালা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নহিলে অনুবাদ