Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


বসন্তরায় - ৩
বসন্তরায়
বর্ণনা পড়িয়া দেখ। কবি এমনি ভাবে মুগ্ধ হইয়া গাহিয়া উঠিয়াছেন যে, প্রথম ছত্র পড়িয়াই আমাদের প্রাণের তার বাজিয়া ওঠে। “সজনি, কি হেরনু ও মুখশোভা! “ শ্যামকে দেখিবামাত্রই যে বন্যার মত এক সৌন্দর্য্যের স্রোত রাধার মনে আসিয়া পড়িয়াছে, রাধার হৃদয়ে সহসা যেন একটা সৌন্দর্য্যের আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে– একেবারে সহসা অভিভূত হইয়া রাধা বলিয়া উঠিয়াছে, “সজনি, কি হেরনু ও মুখশোভা! “ আমরা রাধার সেই সহসা উচ্ছ্বসিত ভাব প্রথম ছত্রেই অনুভব করিতে পারিলাম। শ্যামকে দেখিবামাত্রই তাঁহার প্রথম মনের ভাব– মোহ। প্রথম ছত্রে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে। ইহার সমস্তটা আপ্লুত করিয়া একটা সৌন্দর্য্যের ভাব মাত্র বিরাজ করিতেছে। রাধা মাঝে মাঝে রূপ বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু মনঃপূত না হওয়ায় ছাড়িয়া দিয়াছেন, বলিয়াছেন – “রূপ বরণিব কত, ভাবিতে থকিত চিত।” তাহার রূপ কেমন তাহা আমি কি জানি, তাহার রূপ দেখিয়া আমার চিত্ত কেমন হইল তাহাই আমি জানি। রাধা মাঝে মাঝে বর্ণনা করিতে যায়, অমনি বুঝিতে পারে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্ণনা করিলে খুব অল্পই বলা হয়, আমি যে কি আনন্দ পাইতেছি সেটা তাহাতে কিছুতেই ব্যক্ত হয় না। শ্যামের রূপের আকৃতি ত সজনিরা সকলেই দেখিতে পাইতেছে, কিন্তু রাধা যে সেই রূপের মধ্যে আরো অনেকটা দেখিতে পাইয়াছে, যাহা দেখিয়া তাহার মনে কথার অতীত কথা-সকল জাগিয়া উঠিয়াছে– সেই অধিক-দেখাটা ব্যক্ত করিবে কিরূপে? সে কি তিল তিল বর্ণনা করিয়া? বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়া হতাশ হইয়া বর্ণনা বন্ধ করিয়া কেবল ভাবগুলি মাত্র ব্যক্ত করিতে হয়। হাসি বর্ণনা করিতে গিয়া “হাসি-খানি” বলিতে হয়, রূপ বর্ণনা করিতে গিয়া মুরলীর গান মনে পড়ে। শ্যামের ভাব– রূপেতে হাসিতে গানেতে জড়িত একটি ভাব, পৃথক্‌ পৃথক্‌ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমষ্টিগত একটি ভাব নহে। রাধা যে বলিয়াছেন “হেরইতে চাঁদমুখ মরমে পরম সুখ”, ঐ কথাটাই সত্য– নহিলে, “ভুরু বাঁকা “ বা “চোখ টানা” বা “নাক সোজা “ ও-সব কথা কোন কাজের কথাই নয়।

বিদ্যাপতি-রচিত রূপবর্ণনার সহিত বসন্তরায় রচিত রূপবর্ণনার একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। বিদ্যাপতি রূপকে একরূপ চক্ষে দেখিতেছেন, আর বসন্তরায় তাহাকে আর-এক চক্ষে দেখিতেছেন। বিদ্যাপতি কহিতেছেন, রূপ উপভোগ্য বলিয়া সুন্দর; আর বসন্তরায় কহিতেছেন, রূপ সুন্দর বলিয়া উপভোগ্য। ইহা সত্য বটে, সৌন্দর্য্য ও ভোগ একত্রে থাকে; কিন্তু ইহাও সত্য উভয়ে এক নহে। বসন্তরায় তাঁহার রূপবর্ণনায় যাহা কিছু সুন্দর তাহাই দেখাইয়াছেন, আর বিদ্যাপতি তাঁহার রূপবর্ণনায় যাহা কিছু ভোগ্য তাহাই দেখাইয়াছেন। উদাহরণ দেওয়া যাক্‌। বিদ্যাপতির, যেখান হইতে খুশী, একটি রূপবর্ণনা বাহির করা যাক্‌। –

গেলি কামিনী         গজবরগামিনী

বিহসি পালটি নেহারি।

ইন্দ্রজালক              কুসুমসায়ক

কুহকী ভেল বরনারী।

জোরি ভুজযুগ         মোড় বেড়ল,

ততহি বয়ান সুছন্দ।

দামচম্পকে            কামপূজল

যৈছে সারদচন্দ।

উরহি অঞ্চল         ঝাঁপি চঞ্চল,

আধ পয়োধর হেরু।

পবন-পরভাবে         শরদঘন জনু

বেকত কয়েল সুমেরু।