Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)
চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি - ৫
চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি
তাহার শ্যামকে কে লইল। একটা অলীক আশঙ্কা মাত্রও প্রাণ পাইয়া তাহার সম্মুখে জীবন্ত হইয়া দাঁড়ায়, কাজেই রাধা তাহার সহিত বিবাদ করে। সে বলে –
সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।
যদিও তাহার বঁধুকে এখনো কেহ ভাঙ্গায় নি, কিন্তু তা বলিয়া সে সুস্থির হইতে পারিতেছে কৈ? যখন শ্যাম তাহার সম্মুখে রহিয়াছে, তখনো সে শ্যামকে কহিতেছে –
কি মোহিনী জান বঁধু, কি মোহিনী জান!
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন!
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি –
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি!
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর–
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।
কোন্ বিধি সিরজিল সোতের সেঁওলি,
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।
রাধার আর সোয়াস্তি নাই। শ্যাম সম্মুখে রহিয়াছেন, শ্যাম রাধার প্রতি কোন উপেক্ষা প্রকাশ করেন নাই, তবুও রাধা একটা “যদি”কে গড়িয়া তুলিয়া, একটা “যদি”কে জীবন দিয়া কাঁদিয়া সারা হইল। কহিল –
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।
বঁধু নিদারুণ না হইতে হইতেই সে ভয়ে সশঙ্কিত। রাধার কি আর সুখ আছে? একদিন রাধা গৃহে গঞ্জনা খাইয়া শ্যামের কাছে আসিয়া কাঁদিয়া কহিতেছে –
তোমারে বুঝাই বঁধু, তোমারে বুঝাই,
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন কেহ নাই।
এত করিয়া বুঝাইবার আবশ্যক কি? শ্যাম কি বুঝেন না? কিন্তু তবু রাধার সর্ব্বদাই মনে হয়, “কি জানি! “ মনে হয়, শ্যামও পাছে আমাকে ডাকিয়া না শুধায়। যদিও শ্যামের সেরূপ ভাব দেখে নাই, তবুও ভয় হয়। তাই অত করিয়া আজ বুঝাইতে আসিয়াছে –
তোমারে বুঝাই বঁধু, তোমারে বুঝাই,
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন কেহ নাই।
অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে,
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।
এ ছার পরাণে আর কিবা আছে সুখ?
মোর আগে দাঁড়াও, তোমার দেখিব চাঁদ মুখ।