এ কবিতাতে একটি বিশেষ ভাবকে সমগ্র রাখা হয় নাই। মাঝখানে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। যে বিশাল কল্পনায় একটি ভাব সমগ্র প্রতিবিম্বিত হয়, যাহাতে যোড়াতাড়া দিতে হয় না, সে কল্পনা ইহাতে প্রকাশিত হয় নাই। অরণ্য পর্ব্বত প্রান্তরে যত কিছু সুখ পাওয়া যায়, তাহাই যে রাখালের আয়ত্তাধীন– যে ব্যক্তি গোলাপের শয্যা ফুলের টুপি ও পাতার আঙিয়া নির্ম্মাণ করিয়া দিবার লোভ দেখাইতেছে সে স্বর্ণখচিত পাদুকা, রজতের পাত্র, হস্তিদন্তের আসন পাইবে কোথায়? তৃণনির্ম্মিত কটিবন্ধের মধ্যে কি প্রবাল শোভা পায়? কবিকঙ্কণের কমলে-কামিনীতে একটি রূপসী ষোড়শী হস্তী গ্রাস ও উদগার করিতেছে, ইহাতে এমন পরিমাণ সামঞ্জস্যের অভাব হইয়াছে যে, আমাদের সৌন্দর্য্যজ্ঞানে অত্যন্ত আঘাত দেয়। শিক্ষিত, সংযত, মার্জ্জিত কল্পনায় একটি রূপসী যুবতীর সহিত গজাহার ও উদগীরণ কোনমতেই একত্রে উদয় হইতে পারে না।
কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিকা পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিতান্ত হ্রস্ব দেখায়। অশিক্ষিতদের কুগঠিত কল্পনাদর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসঙ্গত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকেরা কবি, তবে নিতান্ত বালকের মত কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভাল কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই, বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষরূপে কবি। তুমি বল দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন্ জাতির মধ্যে ভাল কবিতা আছে যে জাতি সভ্য হয় নাই। যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল তখন প্রাচীন কাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারো মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে? ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে মহা মহা কবিরা ইংলণ্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কবিতায় কি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রভাব লক্ষিত হয় না?Copleston কহেন : Nevwr has there been a city of which its people might be more justly proud, whether they looked to its past or its future, than Athens in the days of Aeschylus.
অনেকে কল্পনা করেন যে, অশিক্ষিত অবস্থায় কবিত্বের বিশেষ স্ফূর্ত্তি হয়; তাহার একটি কারণ এই যে, তাঁহাদের মতে একটি বস্তুর যথার্থ স্বরূপ না জানিলে তাহাতে কল্পনার বিচরেণর সহস্র পথ থাকে। সত্য একটি মাত্র, মিথ্যা অগণ্য। অতএব মিথ্যায় কল্পনার যেরূপ উদরপূর্ত্তি হয় সত্যে সেরূপ হয় না। পৃথিবীতে অখাদ্য যত আছে তাহা অপেক্ষা খাদ্য বস্তু অত্যন্ত পরিমিত। একটি খাদ্য যদি থাকে ত সহস্র অখাদ্য আছে। অতএব এমন মত কি কোন পণ্ডিতের মুখে শুনিয়াছ যে, অখাদ্য বস্তু আহার না করিলে মনুষ্য-বংশ ধ্বংস হইবার কথা?
প্রকৃত কথা এই যে, সত্যে যত কবিতা আছে, মিথ্যায় তেমন নাই। শত সহস্র মিথ্যার দ্বারে দ্বারে কল্পনা বিচরণ করিতে পারে, কিন্তু এক মুষ্টি কবিতা সঞ্চয় করিতে পারে কি না সন্দেহ; কিন্তু একটি সত্যের কাছে যাও, তাহার দশগুণ অধিক কবিতা পাও কি না দেখ দেখি। কেনই বা তাহার ব্যতিক্রম হইবে বল? আমরা ত প্রকৃতির কাছেই কবিতা শিক্ষা করিয়াছি, প্রকৃতি কখনো মিথ্যা কহেন না। আমরা কি কখনো কল্পনা করতে পারি যে, লোহিতবর্ণ ঘাসে আমাদের চক্ষু জুড়াইয়া যাইতেছে? বল দেখি, পৃথিবী নিশ্চল রহিয়াছে ও আকাশে অগণ্য তারকারাজি নিশ্চলভাবে খচিত রহিয়াছে ইহাতে অধিক কবিত্ব, কি সমস্ত তারকা নিজের পরিবার লইয়া ভ্রমণ করিতেছে তাহাতে অধিক কবিত্ব; এমনি তাহাদের তালে তালে পদক্ষেপ যে, একজন জ্যোতির্ব্বিদ্ বলিয়া দিতে পারেন-কাল যে গ্রহ অমুক স্থানে ছিল আজ সে কোথায় আসিবে। প্রথম কথা এই যে, আমাদের কল্পনা প্রকৃতি অপেক্ষা কবিত্বপূর্ণ বস্তু সৃজন করিতে অসমর্থ; দ্বিতীয় কথা এই যে, আমরা যে অবস্থার মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছি তাহার বহির্ভূত সৌন্দর্য্য অনুভব করিতে পারি না।