পরদিন আমি আর থাকিতে পারিলাম না। প্রাতঃকালে আমার প্রতিবেশীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। ভবনাথবাবু তখন বড়ো এক পেয়ালা চা পাশে রাখিয়া চোখে চশমা দিয়া নীলপেন্সিলে দাগ-করা একখানা হ্যামিল্টনের পুরাতন পুঁথি মনোযোগ দিয়া পড়িতেছিলেন। আমি ঘরে প্রবেশ করিলে চশমার উপরিভাগ হইতে আমাকে কিয়ৎক্ষণ অন্যমনস্কভাবে দেখিলেন, বই হইতে মনটাকে এক মুহূর্তে প্রত্যাহরণ করিতে পারিলেন না। অবশেষে অকস্মাৎ সচকিত হইয়া ত্রস্তভাবে আতিথ্যের জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠিলেন। আমি সংক্ষেপে আত্মপরিচয় দিলাম। তিনি এমনি শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন যে চশমার খাপ খুঁজিয়া পাইলেন না। খামকা বলিলেন “আপনি চা খাইবেন?” আমি যদিও চা খাই না, তথাপি বলিলাম, “আপত্তি নাই।” ভবনাথবাবু ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া ‘কিরণ’ ‘কিরণ’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। দ্বারের নিকট অত্যন্ত মধুর শব্দ শুনিলাম, “কী বাবা।” ফিরিয়া দেখিলাম, তাপসকন্বদুহিতা সহসা আমাকে দেখিয়া ত্রস্ত হরিণীর মতো পলায়নোদ্যত হইয়াছেন। ভবনাথবাবু তাঁহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন; আমার পরিচয় দিয়া কহিলেন, “ইনি আমাদের প্রতিবেশী মহীন্দ্রকুমার বাবু।” এবং আমাকে কহিলেন, “ইনি আমার কন্যা কিরণবালা।” আমি কী করিব ভাবিয়া পাইতেছিলাম না, ইতিমধ্যে কিরণ আমাকে আনম্রসুন্দর নমস্কার করিলেন। আমি তাড়াতাড়ি ত্রুটি সারিয়া লইয়া তাহা শোধ করিয়া দিলাম। ভবনাথবাবু কহিলেন, “মা, মহীন্দ্রবাবুর জন্য এক পেয়ালা চা আনিয়া দিতে হইবে।” আমি মনে মনে অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিলাম কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছু বলিবার পূর্বেই কিরণ ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আমার মনে হইল, যেন কৈলাসে সনাতন ভোলানাথ তাঁহার কন্যা স্বয়ং লক্ষ্মীকে অতিথির জন্য এক পেয়ালা চা আনিতে বলিলেন; অতিথির পক্ষে সে নিশ্চয়ই অমিশ্র অমৃত হইবে, কিন্তু তবু, কাছাকাছি নন্দীভৃঙ্গী কোনো বেটাই কি হাজির ছিল না!
ভবনাথবাবুর বাড়ি আমি এখন নিত্য অতিথি। পূর্বে চা জিনিসটাকে অত্যন্ত ডরাইতাম, এক্ষণে সকালে বিকালে চা খাইয়া খাইয়া আমার চায়ের নেশা ধরিয়া গেল।
আমাদের বি.এ. পরীক্ষার জন্য জর্মানপণ্ডিত-বিরচিত দর্শনশাস্ত্রের নব্য ইতিহাস আমি সদ্য পাঠ করিয়া আসিয়াছিলাম, তদুপলক্ষে ভবনাথবাবুর সহিত কেবল দর্শন আলোচনার জন্যই আসিতাম কিছুদিন এইপ্রকার ভান করিলাম। তিনি হ্যামিল্টন প্রভৃতি কতকগুলি সেকাল-প্রচলিত ভ্রান্ত পুঁথি লইয়া এখনো নিযুক্ত রহিয়াছেন, ইহাতে তাঁহাকে আমি কৃপাপাত্র মনে করিতাম, এবং আমার নূতন বিদ্যা অত্যন্ত আড়ম্বরের সহিত জাহির করিতে ছাড়িতাম না। ভবনাথবাবু এমনি ভালোমানুষ, এমনি সকল বিষয়ে সসংকোচ যে, আমার মতো অল্পবয়স্ক যুবকের মুখ হইতেও সকল কথা মানিয়া যাইতেন, তিলমাত্র প্রতিবাদ করিতে হইলে অস্থির হইয়া উঠিতেন, ভয় করিতেন পাছে আমি কিছুতে ক্ষুণ্ন হই। কিরণ আমাদের এই-সকল তত্ত্বালোচনার মাঝখান হইতেই কোনো ছুতায় উঠিয়া চলিয়া যাইত। তাহাতে আমার যেমন ক্ষোভ জন্মিত তেমনি আমি গর্বও অনুভব করিতাম। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের দুরূহ পাণ্ডিত্য কিরণের পক্ষে দুঃসহ; সে যখন মনে মনে আমার বিদ্যাপর্বতের পরিমাণ করিত তখন তাহাকে কত উচ্চেই চাহিতে হইত।
কিরণকে যখন দূর হইতে দেখিতাম তখন তাহাকে শকুন্তলা দময়ন্তী প্রভৃতি বিচিত্র নামে এবং বিচিত্রভাবে জানিতাম, এখন ঘরের মধ্যে তাহাকে ‘কিরণ’ বলিয়া জানিলাম, এখন আর সে জগতের বিচিত্র নায়িকার ছায়ারূপিণী নহে, এখন সে একমাত্র কিরণ। এখন সে শতশতাব্দীর কাব্যলোক হইতে অবতীর্ণ হইয়া অনন্তকালের যুবকচিত্তের স্বপ্নস্বর্গ পরিহার করিয়া একটি নির্দিষ্ট বাঙালিঘরের মধ্যে কুমারী-কন্যারূপে বিরাজ করিতেছে। সে আমারই মাতৃভাষায় আমার সঙ্গে অত্যন্ত সাধারণ ঘরের কথা বলিয়া থাকে, সামান্য