একটি উদাহরণ দিই। জগতের একটি প্রধান ধর্ম পরার্থপরতা। স্বার্থপরতা জগতের ধর্মবিরুদ্ধ। এই নিমিত্ত জগতের কোথাও স্বার্থপর নাই। পরের জন্য কাজ করিতেই হইবে তা ইচ্ছা কর আর না কর। জগতের প্রত্যেক পরমাণু তাহার পরবর্ত্তী ও তাহার নিকটবর্ত্তীর জন্য, তাহার নিজের মধ্যে তাহার বিরাম নাই। তাহার প্রত্যেক কার্য্য অনন্ত জগতের লক্ষকোটি স্নায়ুর মধ্যে তরঙ্গিত হইতেছে। একটি বালুকণা যদি কেহ ধ্বংস করিতে পারে তবে নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের পরিবর্ত্তন হইয়া যায়। তুমি স্বার্থপরভাবে বিদ্যা উপার্জন ও মনের উন্নতি সাধন করিলে, কিন্তু জানিতেও পারিলে না, সে বিদ্যার ও সে উন্নতির লক্ষকোটি উত্তরাধিকারী আছে। তুমি দাও না-দাও তোমার সন্তানশ্রেণীর মধ্যে সে উন্নতি প্রবাহিত হইবে। তোমার আশে-পাশে চারি দিকে সেই উন্নতির ঢেউ লাগিবে। তুমি ত দুই দিনে পৃথিবী হইতে সরিয়া পড়িবে, কিন্তু তোমার জীবনের সমস্তটাই পৃথিবীর জন্য রাখিয়া যাইতে হইবে—তুমি মরিয়া গেলে বলিয়া তোমার জীবনের এক মুহূর্ত্ত হইতে ধরণীকে বঞ্চিত করিতে পারিবে না, প্রকৃতির আইন এমনি কড়াক্কড়।
অতএব এ জগতে স্বার্থপর হইবার যো নাই। পরার্থপরতাই এ জগতের ধর্ম। এই নিমিত্তই মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট ধর্ম পরের জন্য আত্মোৎসর্গ করা। জগতের ধর্ম আমাদিগকে আগে হইতেই পরের জন্য উৎসৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছে, সে বিষয়ে আমরা জগতের জড়াদপি জড়ের সমতুল্য। কিন্তু আমরা যখন স্বেচ্ছায় সচেতনে সেই মহাধর্মের অনুগমন করি তখনই আমাদের মহত্ত্ব, তখনই আমরা জড়ের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কেবল তাহাই নয়, তখনই আমরা মহৎ সুখ লাভ করি। তখনই আমরা দেখিতে পাই যে, স্বার্থপরতায় সমস্ত জগৎকে এক পার্শ্বে ঠেলিয়া তাহার স্থানে অতি ক্ষুদ্র আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাই। কিন্তু পারিব কেন? অহর্নিশি অশান্তি, অসুখ, হৃদয় ক্লান্ত হইয়া পড়ে, কিছুতেই তাহার আরাম থাকে না। যতই সে উপার্জন করিতে থাকে, যতই সে সঞ্চয় করিতে থাকে, ততই তাহার ভার বৃদ্ধি হইতে থাকে মাত্র। কিন্তু যখনি আপনাকে ভুলিয়া পরের জন্য প্রাণপণ করি তখনি দেখি সুখের সীমা নাই। তখনি সহসা অনুভব করিতে থাকি সমস্ত জগৎ আমার স্বপক্ষে। আমি ছিলাম ক্ষুদ্র, হইলাম অত্যন্ত বৃহৎ। চন্দ্র সূর্যের সহিত আমার বন্ধুত্ব হইল।
জগতস্রোতে ভেসে চল
যে যেথা আছ ভাই,
চলেছে যেথা রবিশশী
চল রে সেথা যাই!
জগৎ তো কাহাকেও একঘরে করে না, কাহারো ধোপা নাপিত বন্ধ করে না। চন্দ্র সূর্য রৌদ্র বৃষ্টি, জগতের সমস্ত শক্তি সমগ্রের এবং প্রত্যেক অংশের অবিশ্রাম সমান দাসত্ব করিতেছে। তাহার কারণ এই জগতের মধ্যে যে কেহ বাস করে কেহই জগতের বিরোধী