ধর্ম
অচৈতন্য
আমরা যতখানি অচেতন, ততখানি সচেতন নহি ইহা নিশ্চয়ই। আমাদের শরীরের মধ্যে কোথায় কোন্ যন্ত্র কিরূপে কাজ করিতেছে, তাহার কিছুই আমরা জানি না। একটুখানি যেখানে জানি, সেখানে অনেকখানিই জানি না। শরীরের সম্বন্ধে যাহা খাটে, মনের সম্বন্ধেও ঠিক তাহাই খাটে। আমাদের মনে যে কি আছে তাহা অতি যৎসামান্য পরিমাণে আমরা জানি মাত্র, যাহা জানি না তাহাই অগাধ। কিন্তু যাহা জানি না তাহাও যে আছে, ইহা অনেকেই বিশ্বাস করিতে চাহেন না। তাঁহারা বলেন, মনের কার্য জানা, মনে আছে অথচ জানিতেছি না, এ কথাটাই স্বতোবিরুদ্ধ কথা—এমন স্থলে না-হয় বলাই গেল যে তাহা নাই।
বিজ্ঞান-গ্রন্থে নিম্নলিখিত ঘটনা অনেকেই পড়িয়া থাকিবেন। একজন মূর্খ দাসী বিকারের অবস্থায় অনর্গল লাটিন আওড়াইতে লাগিল। সহজ-অবস্থায় লাটিনের বিন্দুবিসর্গও সে জানে না। ক্রমে অনুসন্ধান করিয়া জানা গেল, পূর্বে সে একজন লাটিন পণ্ডিতের নিকট দাসী ছিল। যদিও লাটিন শিখে নাই ও জাগ্রত অবস্থায় তাহার লাটিনের স্মৃতি সম্পূর্ণ নিদ্রিত থাকে, তথাপি উক্ত পণ্ডিত-কর্ত্তৃক উচ্চারিত লাটিন পদগুলি তাহার মনের মধ্যে সমস্তই বাস করিতেছিল। সকলেই জানেন বিজ্ঞান-গ্রন্থে এরূপ উদাহরণ বিস্তর আছে।
বিস্মৃতি
আমাদের স্মরণশক্তি অতি ক্ষুদ্র, বিস্মৃতি অতিশয় বৃহৎ। কিন্তু বিস্মৃতি অর্থে তো বিনাশ বুঝায় না। স্মৃতি বিস্মৃতি একই জাতি। একই স্থানে বাস করে। বিস্মৃতির বিকাশকেই বলে স্মৃতি, কিন্তু স্মৃতির অভাবকেই যে বিস্মৃতি বলে তাহা নহে। এই অতি বিপুল বিস্মৃতি আমাদের মনের মধ্যে বাস করিতেছে। বাস করিতেছে মানে কি নিদ্রিত আছে, তাহা নহে। অবিশ্রাম কাজ করিতেছে, এবং কোন কোনটা স্মৃতিরূপে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে। আমাদের রক্তচলাচল অনুভব করিতেছি না বলিয়া যে রক্ত চলিতেছে না, তাহা বলিতে পারি না। পুরুষানুক্রমবাহী কতশত গুণ আমাদের মধ্যে অজ্ঞাতসারে বাস করিতেছে। তাহার অনেকগুলিই হয়তো আমাতে বিকশিত হইল না, আমার উত্তর পুরুষে বিকশিত হইয়া উঠিবে। এইগুলি, এই অতি নিকটের সামগ্রীগুলিই যদি আমরা না জানিতে পারিলাম, তবে সমস্ত জগতের আত্মা যে আমার মধ্যে গূঢ়ভাবে বিরাজ করিতেছে তাহা আমি জানিব কি করিয়া! জগতের হৃদয়ের মধ্য দিয়া আমার হৃদয়ে যে একই সূত্র চলিয়া গিয়াছে তাহা অনুভব করিব কি করিয়া! কিন্তু সে অবিশ্রাম তাহার কার্য করিতেছে। আমি কি জানি বিশ্ব-সংসারের প্রত্যেক পরমাণু অহর্নিশি আমাকে আকর্ষণ করিতেছে এবং আমিও বিশ্ব-সংসারের প্রত্যেক পরমাণুকে অবিশ্রাম আকর্ষণ করিতেছি? কিন্তু জানি না বলিয়া কোন্ কাজটা বন্ধ রহিয়াছে!
জগতের বন্ধন
বিশ্ব-জগতের মধ্য দিয়া আমাদের মধ্যে যে দৃঢ়সূত্র প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে ইহাই ছিন্ন করিয়া ফেলা মুক্তি, এইরূপ কথা শুনা যায়। কিন্তু ছিন্ন করে কাহার সাধ্য! আমি আর জগৎ কি স্বতন্ত্র? কেবল একটা ঘরগড়া বাঁধনে বাঁধা? সেইটে ছিঁড়িয়া ফেলিলেই আমি বাহির হইয়া যাইব? আমি ত জগৎ-ছাড়া নই, জগৎ আমা-ছাড়া নয়; আমরা সকলেই জগৎকে গণনা করিবার সময়, আমাকে ছাড়া আর সকলকেই জগতের মধ্যে গণ্য করি, কিন্তু জগৎ তো সে গণনা মানে না।