একদল লোক আছেন, তাঁহারা যেখানে যতই পুরাতন হইতে থাকেন সেইখানে ততই অনুরাগসূত্রে বদ্ধ হইতে থাকেন। আর একদল লোক আছেন, তাঁহাদিগকে অভ্যাসসূত্রে কিছুতেই বাঁধিতে পারে না, দশ বৎসর যেখানে আছেন সেও তাঁহার পক্ষে যেমন আর একদিন যেখানে আছেন সেও তাঁহার পক্ষে তেমনি। লোকে হয়ত বলিবে তিনিই যথার্থ দূরদর্শী, অপক্ষপাতী, কেবলমাত্র সামান্য অভ্যাসের দরুন তাঁহার নিকট কোন জিনিষের একটা মিথ্যা বিশেষত্ব প্রতীতি হয় না। বিশ্বজনীনতা তাঁহাতেই সম্ভবে। ঠিক উল্টো কথা। বিশ্বজনীনতা তাঁহাতেই সম্ভবে না। বিশ্বের প্রত্যেক বিঘা প্রত্যেক কাঠাতেই বিশ্ব বর্তমান। এক দিনে তাহা আয়ত্ত হয় না। প্রত্যহ অধিকার বাড়িতে থাকে। যিনি দশ বৎসরে এক স্থানের কিছুই অধিকার করিতে পারিলেন না তিনি বিশ্বকে অধিকার করিবেন কি করিয়া! বিশ্ব সর্ব্বত্রই অসীম গভীর এবং অসীম প্রশস্ত। অতএব বিশ্বের এক কাঠা জমিকে যথার্থ ভালবাসিতে গেলে বিশ্বজনীনতা থাকা চাই।
যাঁহারা বলেন জগৎ মিথ্যা, তাঁহাদের কথা এক হিসাবে সত্য, এক হিসাবে সত্য নয়। বাহির হইতে জগৎকে যেরূপ দেখা যায় তাহা মিথ্যা। তাহার উপরে ঠিক বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। ঈথর কাঁপিতেছে, আমি দেখিতেছি আলো; বাতাসে তরঙ্গ উঠিতেছে, আমি শুনিতেছি শব্দ; ব্যবচ্ছেদবিশিষ্ট অতি সূক্ষ্মতম পরমাণুর মধ্যে আকর্ষণ বিকর্ষণ চলিতেছে, আমি দেখিতেছি বৃহৎ দৃঢ় ব্যবচ্ছেদহীন বস্তু। বস্তুবিশেষ কেনই যে বস্তুবিশেষ রূপে প্রতিভাত হয়, আর-কিছু রূপে হয় না, তাহার কোন অর্থ পাওয়া যায় না। আশ্চর্য্য কিছুই নাই, আমাদের নিকটে যাহা বস্তুরূপে প্রতিভাত হইতেছে, আর একদল নূতন জীবের নিকটে তাহা কেবল শব্দরূপে প্রতীত হইতেছে। আমাদের কাছে বস্তু দেখা ও তাহাদের কাছে শব্দ শোনা একই। এমনও আশ্চর্য্য নহে, আর এক নূতন জীব দৃষ্টি শ্রুতি ঘ্রাণ স্বাদ স্পর্শ ব্যতীত আর এক নূতন ইন্দ্রিয়শক্তি-দ্বারা বস্তুকে অনুভব করে, তাহা আমাদের কল্পনার অতীত। বস্তুকে ক্রমাগত বিশ্লেষ করিতে গেলে তাহাকে ক্রমাগত সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মে পরিণত করা যায়—অবশেষে এমন হইয়া দাঁড়ায় আমাদের ভাষায় যাহার নাম নাই, আমাদের মনে যাহার ভাব নাই। মুখে বলি তাহা অসংখ্য শক্তির খেলা, কিন্তু শক্তি বলিতে আমরা কিছুই বুঝি না। অতএব, আমরা যাহা দেখিতেছি শুনিতেছি তাহার উপরে অনন্ত বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারি না। কাজের সুবিধার জন্য রফা করিয়া কিছু দিনের মত তাহাকে এই আকারে বিশ্বাস করিবার একটা বন্দোবস্ত হইয়াছে মাত্র; আবার অবস্থা-পরিবর্তনে এ চুক্তি ভাঙ্গিলে তাহার জন্য আমরা কিছুমাত্র দায়িক হইব না।
এইখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলিবার ইচ্ছা হইতেছে, এই বেলা সেই কথাটা বলিয়া লই, পুনশ্চ পূর্বকথা উত্থাপন করা যাইবে। অনেক লোক আছেন তাঁহারা কথাবার্ত্তাতেই কি আর কবিতাতেই কি, তুলনা বরদাস্ত করিতে পারেন না। তুলনাকে তাঁহারা নিতান্ত একটা ঘরগড়া মিথ্যারূপে দেখেন; নিতান্ত অনুগ্রহপূর্বক ওটাকে তাঁহারা মানিয়া লন মাত্র। তাঁহারা বলেন, যেটা যাহা সেটাকে তাহাই বল, সেটাকে আবার আর-একটা বলিলে তাহাকে একটা অলঙ্কার বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি, কিন্তু তাহাকে সত্য বলিয়া