অমল বলিত, “এখনো শেষ হয় নি, আর-একটু লিখে শোনাব।”
চারু। না, এখনই শোনাতে হবে।
অমল এখনই শোনাইবার জন্যই ব্যস্ত; কিন্তু চারুকে কিছুক্ষণ কাড়াকাড়ি না করাইয়া সে শোনাইত না। তার পরে অমল কাগজখানি হাতে করিয়া বসিয়া প্রথমটা একটুখানি পাতা ঠিক করিয়া লইত, পেনসিল লইয়া দুই-এক জায়গায় দুটো-একটা সংশোধন করিতে থাকিত, ততক্ষণ চারুর চিত্ত পুলকিত কৌতূহলে জলভারনত মেঘের মতো সেই কাগজ কয়খানির দিকে ঝুঁকিয়া রহিত।
অমল দুই-চারি প্যারাগ্রাফ যখন যাহা লেখে তাহা যতটুকুই হোক চারুকে সদ্য সদ্য শোনাইতে হয়। বাকি অলিখিত অংশটুকু আলোচনা এবং কল্পনায় উভয়ের মধ্যে মথিত হইতে থাকে।
এতদিন দুজনে আকাশকুসুমের চয়নে নিযুক্ত ছিল, এখন কাব্যকুসুমের চাষ আরম্ভ হইয়া উভয়ে আর-সমস্তই ভুলিয়া গেল।
একদিন অপরাহ্নে অমল কালেজ হইতে ফিরিলে তাহার পকেটটা কিছু অতিরিক্ত ভরা বলিয়া বোধ হইল। অমল যখন বাড়িতে প্রবেশ করিল তখনই চারু অন্তঃপুরের গবাক্ষ হইতে তাহার পকেটের পূর্ণতার প্রতি লক্ষ করিয়াছিল।
অমল অন্যদিন কালেজ হইতে ফিরিয়া বাড়ির ভিতরে আসিতে দেরি করিত না; আজ সে তাহার ভরা পকেট লইয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিল, শীঘ্র আসিবার নাম করিল না।
চারু অন্তঃপুরের সীমান্তদেশে আসিয়া অনেকবার তালি দিল, কেহ শুনিল না। চারু কিছু রাগ করিয়া তাহার বারান্দায় মন্মথ দত্তর এক বই হাতে করিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
মন্মথ দত্ত নূতন গ্রন্থকার। তাহার লেখার ধরন অনেকটা অমলেরই মতো, এইজন্য অমল তাহাকে কখনো প্রশংসা করিত না; মাঝে মাঝে চারুর কাছে তাহার লেখা বিকৃত উচ্চারণে পড়িয়া বিদ্রূপ করিত–– চারু অমলের নিকট হইতে সে বই কাড়িয়া লইয়া অবজ্ঞাভরে দূরে ফেলিয়া দিত।
আজ যখন অমলের পদশব্দ শুনিতে পাইল তখন সেই মন্মথ দত্তর ‘কলকণ্ঠ’-নামক বই মুখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া চারু অত্যন্ত একাগ্রভাবে পড়িতে আরম্ভ করিল।
অমল বারান্দায় প্রবেশ করিল, চারু লক্ষও করিল না। অমল কহিল, “কী বোঠান, কী পড়া হচ্ছে।”
চারুকে নিরুত্তর দেখিয়া অমল চৌকির পিছনে আসিয়া বইটা দেখিল। কহিল, “মন্মথ দত্তের গলগণ্ড।”
চারু কহিল, “আঃ, বিরক্ত কোরো না, আমাকে পড়তে দাও।” পিঠের কাছে দাঁড়াইয়া অমল ব্যঙ্গস্বরে পড়িতে লাগিল, “আমি তৃণ, ক্ষুদ্র তৃণ; ভাই রক্তাম্বর রাজবেশধারী অশোক, আমি তৃণমাত্র! আমার ফুল নাই, আমার ছায়া নাই, আমার
মস্তক আমি আকাশে তুলিতে পারি না, বসন্তের কোকিল আমাকে আশ্রয় করিয়া কুহুস্বরে জগৎ মাতায় না –– তবু ভাই অশোক, তোমার ঐ পুষ্পিত উচ্চ শাখা হইতে তুমি আমাকে উপেক্ষা করিয়ো না; তোমার পায়ে পড়িয়া আছি আমি তৃণ, তবু আমাকে তুচ্ছ করিয়ো না।”
অমল এইটুকু বই হইতে পড়িয়া তার পরে বিদ্রূপ করিয়া বানাইয়া বলিতে লাগিল, “আমি কলার কাঁদি, কাঁচকলার কাঁদি, ভাই কুষ্মাণ্ড, ভাই গৃহচালবিহারী কুষ্মাণ্ড, আমি নিতান্তই কাঁচকলার কাঁদি।”
চারু কৌতূহলের তাড়নায় রাগ রাখিতে পারিল না; হাসিয়া উঠিয়া বই ফেলিয়া দিয়া কহিল, “তুমি ভারি হিংসুটে, নিজের লেখা ছাড়া কিছু পছন্দ হয় না।”
অমল কহিল, “তোমার ভারি উদারতা, তৃণটি পেলেও গিলে খেতে চাও।”