এই গুণী কেবল পুতুল তৈরি করত; সে পুতুল রাজবাড়ির মেয়েদের খেলার জন্যে।
বছরে বছরে রাজবাড়ির আঙিনায় পুতুলের মেলা বসে। সেই মেলায় সকল কারিগরই এই গুণীকে প্রধান মান দিয়ে এসেছে।
যখন তার বয়স হল প্রায় চার কুড়ি, এমন সময় মেলায় এক নতুন কারিগর এল। তার নাম কিষণলাল, বয়স তার নবীন, নতুন তার কায়দা।
যে পুতুল সে গড়ে তার কিছু গড়ে কিছু গড়ে না, কিছু রঙ দেয় কিছু বাকি রাখে। মনে হয়, পুতুলগুলো যেন ফুরোয় নি, যেন কোনোকালে ফুরিয়ে যাবে না।
নবীনের দল বললে, “লোকটা সাহস দেখিয়েছে।”
প্রবীণের দল বললে, “একে বলে সাহস? এ তো স্পর্ধা।”
কিন্তু, নতুন কালের নতুন দাবি। এ কালের রাজকন্যারা বলে, “আমাদের এই পুতুল চাই।”
সাবেক কালের অনুচরেরা বলে, “আরে ছিঃ।”
শুনে তাদের জেদ বেড়ে যায়।
বুড়োর দোকানে এবার ভিড় নেই। তার ঝাঁকাভরা পুতুল যেন খেয়ার অপেক্ষায় ঘাটের লোকের মতো ও পারের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
এক বছর যায়, দু বছর যায়, বুড়োর নাম সবাই ভুলেই গেল। কিষণলাল হল রাজবাড়ির পুতুলহাটের সর্দার।
বুড়োর মন ভাঙল, বুড়োর দিনও চলে না। শেষকালে তার মেয়ে এসে তাকে বললে, “তুমি আমার বাড়িতে এসো।”
জামাই বললে, “খাও দাও, আরাম করো, আর সবজির খেত থেকে গোরু বাছুর খেদিয়ে রাখো।”
বুড়োর মেয়ে থাকে অষ্টপ্রহর ঘরকরনার কাজে। তার জামাই গড়ে মাটির প্রদীপ, আর নৌকো বোঝাই করে শহরে নিয়ে যায়।
নতুন কাল এসেছে সে কথা বুড়ো বোঝে না, তেমনিই সে বোঝে না যে, তার নাতনির বয়স হয়েছে ষোলো।
যেখানে গাছতলায় ব’সে বুড়ো খেত আগলায় আর ক্ষণে ক্ষণে ঘুমে ঢুলে পড়ে সেখানে নাতনি গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে; বুড়োর বুকের হাড়গুলো পর্যন্ত খুশি হয়ে ওঠে। সে বলে, “কী দাদি, কী চাই।”
নাতনি বলে, “আমাকে পুতুল গড়িয়ে দাও, আমি খেলব।”
বুড়ো বলে, “আরে ভাই, আমার পুতুল তোর পছন্দ হবে কেন।”
নাতনি বলে, “তোমার চেয়ে ভালো পুতুল কে গড়ে শুনি।”
বুড়ো বলে, “কেন, কিষণলাল।”
নাতনি বলে, “ইস্! কিষণলালের সাধ্যি! ”