খুলনা জেলায় পিসিমার আদি শ্বশুরবাড়ি। সেখানকার গ্রামসম্পর্কের দুটি-চারটি মেয়েকে পিসিমা আনিয়ে রেখেছেন। পিসিমার কাজকর্মে পূজা-অর্চনায় তারা ছিল তাঁর সহকারিণী। তাঁর নানারকম ক্রিয়াকর্মে তাদের না হলে তাঁর চলত না। এ বাড়িতে আর সর্বত্রই অমিয়ার অধিকার ছিল, কেবল পুজোর ঘরে না। অমিয়া তার কারণ জানত না, জানবার চেষ্টাও করত না। পিসিমার মনে ছিল, অমিয়া ভালোরকম লেখাপড়া শিখে এমন ঘরে বিয়ে করবে যেখানে আচার-বিচারের বাঁধাবাঁধি নেই, আর দেবদ্বিজ যেখান থেকে খাতির না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসেন। এটা আক্ষেপের কথা। কিন্তু, এ ছাড়া ওর আর-কোনো গতি হতেই পারে না— বাপের পাতক থেকে মেয়েকে সম্পূর্ণ বাঁচাবে কে। সেই কারণে অমিয়াকে তিনি ঢিলেমির ঢালু তট বেয়ে আধুনিক আচারহীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ হতে বাধা দেন নি। ছেলেবেলা থেকে অঙ্কে আর ইংরেজিতে ক্লাসে সে হয়েছে ফার্স্ট। বছরে বছরে মিশনারি ইস্কুল থেকে ফ্রক প’রে বেণী দুলিয়ে চারটে-পাঁচটা করে প্রাইজ নিয়ে এসেছে। যে-বারে দৈবাৎ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে সে-বারে শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে; প্রায়োপবেশন করতে যায় আর-কি। এমনি করে পরীক্ষাদেবতার কাছে সিদ্ধির মানত করে সে তারই সাধনায় দীর্ঘকাল তন্ময় ছিল। অবশেষে অসহযোগের যোগিনীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পরীক্ষাদেবীর বর্জন-সাধনাতেও সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হল। পাস-গ্রহণেও যেমন, পাস-ছেদনেও তেমনি, কিছুতেই সে কারও চেয়ে পিছিয়ে থাকবার মেয়ে নয়। পড়াশুনো করে তার যে খ্যাতি, পড়াশুনো ছেড়ে তার চেয়ে খ্যাতি অনেক বেশি বেড়ে গেল। আজ যে-সব প্রাইজ তার হাতের কাছে ফিরছে তারা চলে, তারা বলে, তারা অশ্রুসলিলে গলে, তারা কবিতাও লেখে।
বলা বাহুল্য, পিসিমার পাড়াগেঁয়ে পোষ্য মেয়েগুলির ’পরে অমিয়ার একটুও শ্রদ্ধা ছিল না। অনাথাসদনে যে-সময়ে চাঁদার টাকার চেয়ে অনাথারই অভাব বেশি, সেই সময়ে এই মেয়েদের সেখানে পাঠাবার জন্যে পিসিমার কাছে অমিয়া অনেক আবেদন করেছে। পিসিমা বলেছেন, “সে কী কথা— এরা তো অনাথা নয়, আমি বেঁচে আছি কী করতে। অনাথ হোক, সনাথ হোক, মেয়েরা চায় ঘর; সদনের মধ্যে তাদের ছাপ মেরে বস্তাবন্দী করে রাখা কেন। তোমার যদি এতই দয়া থাকে তোমার ঘর নেই নাকি।”
যা হোক, মেয়েটি যখন মাথা হেঁট করে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আমি সংকুচিত অথচ বিগলিতচিত্তে একখানা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে বিজ্ঞাপনের উপর চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলেম। এমন সময় হঠাৎ অকালে অমিয়া ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত; নবযুগের উপযোগী ভাইফোঁটার একটা নূতন ব্যাখ্যা সে লিখেছে। সেইটে ইংরেজিতেও সে প্রচার করতে চায়; আমার কাছে তারই সাহায্য আবশ্যক। এই লেখাটির ওরিজিনাল আইডিয়াতে ভক্তদল খুব বিচলিত— এই নিয়ে তারা একটা ধুমধাম করবে বলে কোমর বেঁধেছে।
ঘর ঢুকেই সেবানিযুক্ত মেয়েটিকে দেখেই অমিয়ার মুখের ভাব অত্যন্ত শক্ত হয়ে উঠল। তার দেশবিশ্রুত দাদা যদি একটু ইশারামাত্র করত তা হলে তার সেবা করবার লোকর কি অভাব ছিল। এত মানুষ থাকতে শেষকালে কি এই—
থাকতে পারলে না। বললে, “দাদা, হরিমতিকে কি তুমি—”