Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


পরিশিষ্ট,২৭
পরিশিষ্ট

সংগীতসুধা নন্দনে (র) সে আলিম্পনে।

ভাগ করে দেখো –

সংগী। ত সুধা। নন্দ। নের সে আ। লিম্পনে।

যদি লিখতে –

সংগীতসুধা নন্দনেরি আলিম্পনে

তাহলে ছন্দের ত্রুটি হত না।

যাক। তারপরে ‘ঐকান্তিকা।’ ওটা প্রাকৃত ছন্দে লেখা। সে ছন্দের স্থিতিস্থাপকতা যথেষ্ট। মাত্রার ওজনের একটু-আধটু নড়চড় হলে ক্ষতি হয় না। তবুও নেহাত ঢিলেমি করা চলে না। বাঁধামাত্রার নিয়মের চেয়ে কানের নিয়ম সূক্ষ্ম; বুঝিয়ে বলা বড়ো শক্ত, কেন ভালো লাগল বা লাগল না। ‘ঐকান্তিকা’র ছন্দটা বন্ধুর হয়েছে সে-কথা বলতেই হবে। অনেক জায়গায় দূরান্বয়ের জন্যে এবং ছন্দের বিভাগে বাক্য বিভক্ত হয়ে গেছে বলে অর্থ বুঝতে কষ্ট পেয়েছি। তন্ন তন্ন আলোচনা করতে হলে বিস্তর বাক্য ও কাল-ব্যয় করতে হয়। তাই আমার কান ও বুদ্ধি অনুসরণ করে তোমার কবিতাকে কিছু কিছু বদল করেছি। তুমি গ্রহণ করবে এ আশা করে নয়, আমার অভিমতটা অনুমান করতে পারবে এই আশা করেই।

২

তুমি এমন করে সব প্রশ্ন ফাঁদ যে দুচার কথায় সেরে দেওয়া অসম্ভব হয়, তোমার সম্বন্ধে আমার এই নালিশ।

১। ‘আবার এরা ঘিরেছে মোর মন’– এই পঙ্‌ক্তির ছন্দোমাত্রার সঙ্গে ‘দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে’র মাত্রার অসাম্য ঘটেছে এই তোমার মত। ‘ক্রমে’ শব্দটার ‘ক্র’র উপর যদি যথোচিত ঝোঁক দাও তাহলে হিসাবের গোল থাকে না। ‘বেড়ে ওঠেক্‌রমে’ – বস্তুত সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে ‘ক্র’ পরে থাকাতে ‘ওঠে’র ‘এ’ স্বরবর্ণে মাত্রা বেড়ে ওঠা উচিত। তুমি বলতে পার, আমরা সাধারণত শব্দের প্রথম বর্ণস্থিত র-ফলাকে দুই মাত্রা দিতে কৃপণতা করি। ‘আক্রমণ’ শব্দের ‘ক্র’কে তার প্রাপ্য মাত্রা দিই, কিন্তু ‘ওঠে ক্রমে’র ‘ক্র’ হ্রস্বমাত্রায় খর্ব করে থাকি। আমি সুযোগ বুঝে বিকল্পে দুইরকম নিয়মই চালাই।

২। ভক্‌ত। সেথায়। খোলো দ্বা। ০০র্‌। এইরকম ভাগে কোনো দোষ নেই। কিন্তু, তুমি যে ভাগ করেছিল। র০০। এটা চলে না; যেহেতু ‘র’ হসন্ত বর্ণ, ওর পরে স্বরবর্ণ নেই, অতএব টানব কাকে।

৩। ‘জনগণ’ গান যখন লিখেছিলেম তখন ‘মারাঠা’ বানান করি নি। মরাঠিরাও প্রথমবর্ণে আকার দেয় না। আমার ছিল ‘মরাঠা’। তারপরে যাঁরা শোধন করেছেন তাঁরাই নিরাকারকে সাকার করে তুলেছেন, আমার চোখে পড়ে নি।

৪। ‘জাগিয়ে’ ও ‘রটিয়ে’ শব্দের ‘গিয়ে’ ও ‘টিয়ে’ প্রাকঁত-বাংলার মতে একমাত্রাই। আমি যদি পরিবর্তন করে থাকি সেটাকে স্বীকার করবার প্রয়োজন নেই।

৩

তুমি যে ‘ম্লান’ শব্দটিকে হসন্তভাবে উচ্চারণ কর এ আমার কাছে নতুন লাগল। আমি কখনই ‘ম্লান্‌’ বলি নে। প্রাকৃত-বাংলায় যে-সব শব্দ অতিপ্রচলিত তাদেরই উচ্চারণে এইরকম স্বরলুপ্তি সহ্য করা চলে। ‘ম্লান’ শব্দটা সে-জাতের নয় এবং ওটা অতি সুন্দর শব্দ, ওকে বিনা দোষে জরিমানা করে ওর স্বরহরণ কোরো না, তোমার কাছে এই আমার দরবার।