আমি অন্যত্র বলেছি, প্রাকৃত-বাংলার ছন্দে যতিবিভাগ সকল সময় ঠিক কাটা কাটা সমান ভাগে নয়। পাঠক এক জায়গায় মাত্রা হরণ করে আর-এক জায়গায় ওজন রেখে তা পূরণ করে দিলে নালিশ চলে না। এইজন্যে একই কবিতা পাঠক আপন রুচি-অনুসারে কিছু পরিমাণে ভিন্নরকম করে পড়তে পারেন।
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপরতন আশা করি।
ঘাটে ঘাটে ফিরব না আর
ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।
এই কবিতাটি আমি পড়ি ‘রূপ’ এবং ‘ডুব’ এবং ‘অরূপ’ শব্দের ধ্বনিকে দীর্ঘ করে। অর্থাৎ ঐ উকারগুলোর ওজন হয় দুইমাত্রার কিছু বেশি। তখন তারই পূরণস্বরূপে ‘ডুব দিয়েছি’র পরে যতিকে থামতে দেওয়া যায় না। অপরপক্ষে ‘ঘাটে ঘাটে’ শব্দে মাত্রাহ্রাসের ত্রুটি পূরণ করবার বরাত দেওয়া যায় ‘ফিরব না’ শব্দের উপর; নইলে লিখতে হত ‘সাতঘাটে আর ফিরব না ভাই’।
সংস্কৃত-বাংলা ও প্রাকৃত-বাংলার ছন্দে লয়ের যে ভেদ কানে লাগে তার কারণ সংস্কৃত-বাংলায় অনেক স্থলেই যে-শব্দের মাপ দুইয়ের তার ওজনও দুইয়ের। যেমন–
১ | ২ | ১ | ২ |
তো | মা | স | নে। |
কিন্তু প্রাকৃত-বাংলায় প্রায়ই সে স্থলে মাপ দুইয়ের হলেও ওজন তিনের। যেমন–
১ | ২ | ১ | ২ |
তো | মার | সঙ্ | গে। |
এতে করে তিন-ঘেঁষা ছন্দের প্রকৃতি বদলে যায়।
‘রূপসাগরে’ গানটির পরিবর্তে লেখা যেতে পারত–
ঘাটে ঘাটে ফিরিব না বেয়ে মোর ভাঙা তরী।
যদি কেউ বলেন, দুটোর একই ছন্দ, তাহলে এইটুকু বলে চুপ করব যে, আমার সঙ্গে মতে মিলল না। কেননা, আমি ছন্দ গুনি নে, আমি ছন্দ শুনি।
বেদনার রাঙা মেঘে পেয়েছে মহিমা।
এখানে ‘দিক্’ শব্দের ক্ হসন্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে একমাত্রার পদবি দেওয়া গেল। নিশ্চিত জানি, পাঠক সেই পদবির সম্মান স্বতই রক্ষা করে চলবেন।